শ্যামাপোকার পাখা আর ওড়ে না কেন?

পরিবেশ যদি দূষণমুক্ত না হয়, যথেচ্ছ কীটনাশক ব্যবহারের উপরে যদি নিয়ন্ত্রণ না আসে, তবে এক দিন হাতেগোনা যে ক’টা শ্যামাপোকা দেখা যাচ্ছে, তা-ও দেখা যাবে না। লিখলেন সুদীপ ভট্টাচার্যএক সময়ে বাংলার অতি পরিচিত এই সব পোকা বর্তমান প্রজন্মের অনেকের কাছেই এখন বেশ অপরিচিত মুখ। নতুন প্রজন্মের ক’জনের সঙ্গে তাদের সম্মুখ সাক্ষাৎ হয়েছে সেটাও লাখ টাকার প্রশ্ন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০১৯ ০২:৪২
Share:

শ্যামাপোকা।

আশির দশকের প্রথম দিকে আশা ভোঁসলের গলায় বাঙালির মনে দোলা দেওয়া সেই পুজোর গানের লাইনগুলো মনে আছে? ‘‘কাচপোকা, শ্যামাপোকা, পোকার নানান জাতি, এত পোকার মধ্যে কেন জোনাকি দেয় বাতি?’’

Advertisement

কিংবা সত্যজিৎ রায়ের লেখা ফেলুদা সিরিজের ‘টিনটোরেটোর যীশু’র কথা মনে পড়ে? যেখানে দেওয়ালে টাঙানো টিনটোরেটোর যীশুর ছবিটা যে নকল আর তা যে গত দু’এক দিনের মধ্যেই আঁকা হয়েছে, তা ফেলুদা ধরেছিলেন ছবিতে যীশুর কপালে আটকে থাকা একটা শ্যামাপোকা দেখে। রাতের অন্ধকারে মোমবাতি বা কেরোসিনের বাতি জ্বালিয়ে ছবিটা আঁকার সময় ওই শ্যামাপোকা ছবিতে আটকে গিয়েছিল। সেই সূত্র ধরেই রহস্যভেদ।

এক সময়ে বাংলার অতি পরিচিত এই সব পোকা বর্তমান প্রজন্মের অনেকের কাছেই এখন বেশ অপরিচিত মুখ। নতুন প্রজন্মের ক’জনের সঙ্গে তাদের সম্মুখ সাক্ষাৎ হয়েছে সেটাও লাখ টাকার প্রশ্ন। এখন তো এই সব পোকার বাস শুধুমাত্র বইয়ের পাতা বা গুগ্‌ল সার্চে। সবুজ রঙের চকচকে পিঠের উপর কালো ফুটকির কাচপোকা দেখতে খুব সুন্দর আর উজ্জ্বল হওয়ায় এই পোকা ছোটদের খুব প্রিয় ছিল। এই সৌন্দর্য তাদের সর্বনাশও ডেকে আনত অনেক সময়ে। যেমন অনেকেই বিশেষ করে আদিবাসী মহিলারা কাচপোকার শক্ত চকচকে খোলসকে কপালের টিপ হিসাবে ব্যবহার করতেন। এক সময়ে লতা, গুল্মে প্রচুর পরিমাণে দেখতে পাওয়া কাচপোকা আজ বিরল।

Advertisement

কিছু দিন আগেও কালীপুজোর মুখে ঘরে আলোই জ্বালানো যেত না শ্যামাপোকার অত্যাচারে। টিউব বা বাল্ব জ্বালালেই দলে দলে ছোট্ট ছোট্ট সবুজ শ্যামাপোকা আলোর চারপাশে জড়ো হত। শ্যামাপুজোর সময়ে এই পোকা দেখা যায় বলে শ্যামাপোকা নাম বলে অনেকে মনে করেন। আবার, গায়ের রং শ্যামল বা সবুজ হওয়ার কারণেও হয়তো এদের শ্যামাপোকা বলা হয় বলে মনে করেন কেউ কেউ। সারা সন্ধে আলোর চারপাশের ঘুরে, পরের দিন সকালবেলা সারা ঘরে ছড়িয়েছিটিয়ে পড়ে থাকত অগুনতি মরা শ্যামাপোকা।

আলোটা যদি প্রদীপ বা মোমের হত, তা হলে সেই প্রদীপ বা মোমের লকলকে শিখায় সরাসরি লাফিয়ে পড়ে ঝলসে মারা যেত তারা। পোকা থেকে বাঁচতে সন্ধ্যা হলেই বাড়ির আলো নিভিয়ে রাখা হত। তেলেভাজা বা মিষ্টির দোকানে জ্বলতে থাকা টিউবের নীচে মশারি বা পোকারা যাতে আটকা পড়ে সে জন্য পাতাসমেত গাছের ডাল বেঁধে দেওয়া ছিল অত্যন্ত পরিচিত দৃশ্য। সেই শ্যামাপোকারা বেশ কয়েক বছর ধরে সে ভাবে আর চোখে পড়ছে না। এই বছর তো শ্যামাপুজোয় শ্যামাপোকার দেখাই মিলল না।

জোনাকির কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। বড় বড় বৈদ্যুতিক আলোর কাছে লজ্জা পেয়ে মনে হয় তাদের শরীরের আলো নিভিয়ে অন্ধকারে মুখ লুকিয়েছে তারা। যাতে কেউ তাদের খুঁজে না পায়। গ্রামবাংলায় যা-ও বা দু’চারটে এই সব হারিয়ে যেতে বসা পোকাদের দেখা মেলে, শহরে পোকা দেখতে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।

শ্যামাপোকাদের হারিয়ে যেতে বসার রহস্য অনুসন্ধান করতে গেলে প্রথমেই জানতে হবে এরা কারা? কী তাদের পরিচয়? শ্যামাপোকা (green rice plant hopper) হল ধান গাছের একটা পেস্ট (ক্ষতিকারক পোকা)। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম— Nephotettix nigropictus Stal। হেমিপটেরা বর্গের এই পোকাগুলোকে সাধারণত ‘বাগ’ নামে ডাকা হয়, এরা নানা রকম ঘাস বা ভিজে জায়গায় ডিম পাড়ে। এদের চোষক প্রকৃতির মুখের উপাঙ্গ দিয়ে এরা ধান গাছের পাতা ফুটো করে রস খায়। সাধারণত মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এরা জীবনের বেশ কয়েকটা জীবনচক্র সম্পন্ন করে। মোটামুটি কালীপুজোর সময় থেকে তীব্র শীত পড়া পর্যন্ত সন্ধ্যাবেলা আলোর চারপাশে এদের সব থেকে বেশি চোখে পড়ে। এই সময়টায় হালকা শীতের নির্দিষ্ট উষ্ণতা এবং বৃষ্টি না হওয়ায় এদের বংশবিস্তারের জন্য উপযুক্ত সময়। সর্বোপরি, এই সময় মাঠে সদ্য শিস আসা ধান গাছ থেকে প্রচুর খাবার পাওয়ার সুযোগ থাকে বলে এই সময়েই সব চেয়ে বেশি শ্যামাপোকা চোখে পড়ে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। শীত বাড়লে শ্যামাপোকারা পিউপা অবস্থায় পুরো শীতকালটা ঘাসের বা ধান গাছের গোড়ায় থেকে যায়, একে ডায়াপজ দশা বলে।

এদের হারিয়ে যেতে বসার কারণ হিসাবে বাঁকুড়ার সোনামুখী কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক তথা পতঙ্গ-গবেষক শুভ্রকান্তি সিনহা বেশ কয়েকটি কারণকে দায়ী করছেন। তার মধ্যে প্রধান কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘‘শুধু শ্যামাপোকা নয়, এই সময়ে দেখতে পাওয়া বিভিন্ন মথ, বিটল (গুবরে পোকা), গঙ্গাফড়িং সহ বেশ কিছু প্রজাতির ফড়িং সবই আস্তে আস্তে কমে আসছে জমিতে অপরিকল্পিত ও যথেচ্ছ পরিমাণ কীটনাশক প্রয়োগের ফলে।’’ এই কীটনাশক প্রয়োগে জমির শত্রু পোকা তো বটেই, ফড়িং-এর মতো অনেক বন্ধু পোকা, যারা অন্য পোকাদের খেয়ে ফসল রক্ষা করে, তারাও মারা যাচ্ছে ব্যাপক হারে।

আর একটি কারণ হিসাবে তিনি জানালেন, এককালে শ্যামাপোকা ধান গাছের প্রধান ক্ষতিকারক পোকা (major pest) ছিল। এখন অনেকটা তাদের মতোই আকৃতিবিশিষ্ট বাদামি চোষক পোকা (brown rice plant hopper) শ্যামাপোকাকে পিছনে ফেলেছে। তারাই ধানের প্রধান ক্ষতিকারক পোকার জায়গা দখল করেছে। একই ধরনের জীবদের ক্ষেত্রে নিজেদের আধিপত্য রক্ষার জন্য এই লড়াইকে বাস্তুবিদ্যায় ‘নিসে শিফটিং’ (niche shifting) বলে।

তাই এখন যে জায়গায় আলোর চারপাশে পোকারা ভিড় করে, সেখানে একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে— শ্যামাপোকার সংখ্যা কম, বাদামি চোষক পোকাই বেশি। কারও কারও মতে অতিবৃষ্টিতে ঘাস-জমি ডুবে যাওয়াও শ্যামাপোকার সংখ্যা কমার একটা কারণ হতে পারে।

কৃষ্ণনগরের গোয়ারিবাজারের বাসিন্দা সোমা দত্তের ফ্ল্যাটের বারান্দার দরজা খুলে রাখলে এই সময়ে এখনও ঘরের টিউবলাইটকে ঘিরে ধরে পোকার দল। তিনিও বলেন, ‘‘সত্যি বেশ কয়েক বছর ধরে দেখছি কমে এসেছে শ্যামাপোকা, এখন যেগুলো ভিড় করে তা আকারে আরও ছোট, বাদামি রঙের আর কয়েকটা ফড়িং জাতীয় পোকাও দেখা যায়।’’ পরিবেশ যদি দূষণমুক্ত না হয়, যথেচ্ছ কীটনাশক ব্যবহারের উপরে যদি নিয়ন্ত্রণ না আসে তবে এক দিন হয়তো হাতেগোনা যে ক’টা পোকা দেখা যাচ্ছে, তা-ও দেখা যাবে না অদূর ভবিষ্যতে। এক সময়ে যখন সন্ধে নামলে কম আলো জ্বলত, তখন সেই আলো ঘিরে পোকার সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। আজ যখন আলোয় ঢেকেছে শহর, তখন সেই আলোর ভিড়ে অন্য পোকাদের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যেতে বসেছে শ্যামাপোকারাও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন