প্রধানমন্ত্রী কি অর্ধসত্যকেই শিরোধার্য করলেন?

আপনি আচরি ধর্ম...

আপাতত সেই সব প্রসঙ্গে না গিয়ে শুধু পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকানো যাক। প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকারের কিছুটা অংশ দখল করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্য। মোদীর অভিযোগ, এই রাজ্যে বিজেপিকে গণতান্ত্রিক অধিকার দেওয়া হচ্ছে না।

Advertisement

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share:

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে নববর্ষের শুভেচ্ছা। ভাগ্যিস বছরের প্রথম দিনে টিভির পর্দায় তাঁর ঘণ্টা দেড়েকের সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠান দেখার ‘সুযোগ’ তিনি দেশবাসীকে করে দিলেন! তা-ই তো বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর চিন্তাভাবনা সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া গেল। সবাই জানতে পারল, ২০১৯-এর নির্বাচনে সাধারণ মানুষ মোদীর পাশ থেকে সরে যাওয়ার মতো তেমন কোনও ‘জনবিরোধী’ কাজ তাঁর সরকার করেনি। তা সে নোটবন্দি, জিএসটি, কৃষিঋণের বোঝা যা-ই হোক!

Advertisement

আপাতত সেই সব প্রসঙ্গে না গিয়ে শুধু পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকানো যাক। প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকারের কিছুটা অংশ দখল করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্য। মোদীর অভিযোগ, এই রাজ্যে বিজেপিকে গণতান্ত্রিক অধিকার দেওয়া হচ্ছে না।

সবাই জানেন, বিজেপির বিরুদ্ধে জোট গড়ে ভোট লড়তে মমতা সক্রিয় ভাবে উদ্যোগী হয়েছেন। তাঁর মুখেই প্রথম শোনা গিয়েছে একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী দেওয়ার জন্য ফেডারাল ফ্রন্ট তৈরির কথা। পাঁচ রাজ্যে সাম্প্রতিক নির্বাচনে বিজেপির পরাজয় দেখার পরে সেই ভাবনা আরও দানা বেঁধেছে। জাতীয় স্তরে কংগ্রেস-সহ বিভিন্ন রাজ্যের শক্তিশালী আঞ্চলিক দলগুলিকে একত্রে নিয়ে জোট করার প্রয়োজনীয়তা সকলেই বুঝতে পারছেন। জাতীয় রাজনীতিতে মমতার গুরুত্বও বাড়ছে।

Advertisement

স্বাভাবিক ভাবেই এমন একটি সময়ে মমতাকে নিশানা করে তির ছোড়ার মধ্যে নরেন্দ্র মোদীর উদ্দেশ্য স্পষ্ট। রাজনীতির নিরিখে তাঁর দিক থেকে এটা ভুল কিছু নয়। কিন্তু একটি আঙুল অন্যের দিকে তোলার সময় অনেকেরই মনে থাকে না, বাকি চার আঙুল তখন নিজের দিকে ফেরানো। মোদীও কি সেটাই করে ফেললেন?

প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক। কারণ মমতার দল ও সরকারকে কাঠগড়ায় তুলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী যা যা বলেছেন এবং যা যা করার পরামর্শ দিয়েছেন, তাঁর নিজের দল তার কোনও দায়ই এড়াতে পারে না। শুধু এই রাজ্যে নয়, দেশ জুড়ে মোদীর বিজেপি যা করে চলেছে, তাতে গণতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাধীনতা, শালীনতা ইত্যাদি শব্দ তাদের অভিধানে আছে কি না, সেই সংশয় ক্রমশ দৃঢ় হয়।

সন্দেহ নেই, রাজ্যে এ বারের পঞ্চায়েত নির্বাচন পর্ব অশান্ত ছিল। মনোনয়নের সময় থেকে বিভিন্ন জেলায় বহু ঘটনা ঘটেছে, যা ঘটা উচিত ছিল না। ৩৪ শতাংশ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শাসক তৃণমূল জিতেছে, এটাও সত্যি। আবার মমতার দল যে হেতু শাসন ক্ষমতায়, তাই প্রাথমিক ভাবে আইনশৃঙ্খলা অবনতির কথা বললে সেটা তাদেরই বিরুদ্ধে যায়।

এ পর্যন্ত সব ঠিক। কিন্তু অশান্তির সব দায় একা তৃণমূলের, এমন সিদ্ধান্ত কি অতিসরলীকরণ নয়? পঞ্চায়েত নির্বাচন পর্বে খুনোখুনির হিসাব নিলে দেখা যায়, অন্য দলগুলির যত লোক খুন হয়েছেন, তার চেয়ে তৃণমূলে নিহতের সংখ্যা বেশি ছাড়া কম নয়। এক হাতে অবশ্যই তালি বাজে না। এ ক্ষেত্রেও তৃণমূল একা ভাল, বাকি দলেরা হিংসাপ্রবণ—সেই ওকালতি আমি অন্তত করব না। বস্তুত যে কোনও দলের এক জন খুন হওয়াও অবাঞ্ছিত এবং নিন্দনীয়। তবে নিহতের তালিকায় চোখ রেখে এটা মানতেই হবে, শাসক দলকে মেরে শেষ করে দেওয়ার যথেষ্ট তাকত বিরোধীদেরও আছে। আর সেই বাস্তব স্বীকার করলে এটাও অনস্বীকার্য যে, গণতন্ত্র এখানে বিরোধীদের দ্বারাও আক্রান্ত।

অর্ধসত্য মিথ্যার চেয়ে ভয়ানক! নববর্ষের প্রথম দিনে প্রধানমন্ত্রী হয়তো সেই অর্ধসত্যকেই শিরোধার্য করেছেন। তাই নির্বাচনী সন্ত্রাসের সবটুকু দায় একা তৃণমূলের উপর চাপিয়ে তিনি বলতে পেরেছেন, ‘‘ভোটের সময় যে ভাবে আমাদের কর্মীদের খুন করা হয়েছে, তাতে পশ্চিমবঙ্গে আদৌ গণতন্ত্র আছে বলে মনে হয় না।’’

জানতে ইচ্ছে করে, ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার যে সব জায়গায় তৃণমূলকে পঞ্চায়েত ভোটে বিজেপি পর্যুদস্ত করল, সেখানেও কি ‘গণতন্ত্র’ ছিল না? যে সব জায়গায় সরকারি দল তৃণমূলই প্রার্থী দিতে পারেনি, তা-ও নিশ্চয় ‘গণতন্ত্রসম্মত’ বলে গণ্য হবে? দেশের সর্বোচ্চ নেতার অবশ্যই এই সব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মাথাব্যথা থাকার কথা নয়। তবু এগুলিও ঘটনা।

‘গণতন্ত্র’ দেখতে এ বার চলুন ত্রিপুরায়। পশ্চিমবঙ্গে মমতার তৃণমূল যেমন ৩৪ বছরের সিপিএম-রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে ইতিহাস গড়েছে, তেমনই প্রতিবেশী রাজ্য ত্রিপুরায় ২৫ বছরের সিপিএম শাসনে ইতি টেনে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বিজেপি। বলতেই হবে, ত্রিপুরায় বিজেপির এই উত্থান পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের উত্থানের চেয়েও চমকপ্রদ। কারণ মমতা এখানে ত্রিশ বছর ধরে রাস্তায় নেমে আন্দোলন, লড়াই করতে করতে এগিয়েছেন। ত্রিপুরায় বিজেপি উঠে এল চকিতে। কেন, কী করে— সেই পর্যালোচনা এ ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক। আপাতত যা হয়েছে, তার ভিত্তিতে পরিস্থিতি দেখা যাক।

বিজেপি-শাসিত ত্রিপুরায় প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচন হল এ বারেই। কী দেখা গেল সেখানে? ৯৬ শতাংশ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই বিজেপি অধিষ্ঠিত! মাননীয় নরেন্দ্র মোদীর নজর পশ্চিমবঙ্গ পেরিয়ে ত্রিপুরা পর্যন্ত পৌঁছেছে কি না, জানা নেই। কারণ সেখানকার কোনও উল্লেখ তাঁর দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে ছিল না। তবু প্রশ্নটা থেকেই যায়। পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ শতাংশ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না-হওয়া যদি বিরোধীদের ‘গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ’ হয়ে থাকে, ত্রিপুরাতেও তা হলে সেটাই আরও বড় আকারে হয়েছে বলে মানতে বাধা কোথায়? পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের সবাই নিশ্চয় ধোয়া তুলসীপাতা নয়। কিন্তু এই দিকে আঙুল তোলার সঙ্গে সঙ্গে ত্রিপুরার দৃষ্টান্ত সামনে রেখে একই ভাবে বলতে হবে, সেখানে বিজেপি যা করেছে, সুস্থ গণতন্ত্রের পক্ষে তা-ও কম কলঙ্কের নয়। পরিহাস হল, দিল্লির মোদী থেকে রাজ্য স্তরে এক পয়সার নেতারা কেউ এমন সত্যের মুখোমুখি হতে চান না!

ঠিক যেমন টিভির পর্দায় সব রাজনৈতিক নেতাদের গণতন্ত্র এবং শিষ্টাচারের ‘সহবত’ শেখার পরামর্শ দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী বোধ হয় ভুলে গিয়েছিলেন, এই রাজ্যেও তাঁর দল আছে এবং সেই দলের নেতা বলে যাঁরা গণ্য হন, দিলীপ ঘোষ তাঁদের অন্যতম। তিনি রাজ্য বিজেপির সভাপতি বলে এটিও ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, নরেন্দ্র মোদীর কাছে তিনি আর পাঁচ জনের তুলনায় অধিক পরিচিত মুখ।

বলে রাখা ভাল, সংবাদমাধ্যমের পক্ষে দিলীপবাবু হয়তো ভাল ‘খোরাক’। তাঁর কথাবার্তা, হুমকি ইত্যাদি খবরের রং বদলে দিতে পারে। অনেকটা তৃণমূল-বীর অনুব্রত মণ্ডলের মতো।

কিন্তু অনুব্রত তো জেলার সভাপতি। তাঁর নড়াচড়া মূলত নিজের জেলায় সীমাবদ্ধ। দিলীপ ঘোষের দায়বদ্ধতা অনেক বেশি। তিনি এমন একটি দলের রাজ্য সভাপতি, যারা নাকি আগামী দিন পশ্চিমবঙ্গ দখলের খোয়াব দেখছে। সেই দলের রাজ্যনেতা রোজ তাঁর বক্তৃতায় ‘শালীনতা’-র যে নজির গড়ছেন, প্রধানমন্ত্রী তার খবর রাখেন কি?

গণতন্ত্রের ‘সহবত’ রক্ষায় উদ্যোগী প্রধানমন্ত্রীর জানা উচিত, তাঁর দলের পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ পদাধিকারী শাসক দলের লোকজনকে মেরে শ্মশানে পাঠাতে চান, ঝান্ডার বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে হাড় ভেঙে দিতে উৎসাহ দেন, মুখ্যমন্ত্রীর সম্পর্কে কুরুচিকর মন্তব্য করে ‘বাহবা’ কুড়োতে চেষ্টা করেন— এমন আরও কত কী। তবু ‘দিলীপ ঘোষ ইজ় অ্যান অনারেবল্ ম্যান!’ এবং তিনি অকুতোভয়।

ম্যাজিক আয়নায় নাকি নিজের ছায়া পড়ে না, শুধু অন্যের মুখ দেখা যায়! মাননীয় নরেন্দ্র মোদীর কাছেও তেমন আয়না আছে বুঝি? নইলে অন্যকে উপদেশ দেওয়ার আগে তাঁর নিজের দলকে তিনি শোধরাতেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement