t n ninan

জীবনের প্রকৃত মূল্য কত, অতিমারি কি শেখাতে পারল?

পুরো ব্যাপারটাই নির্ভর করে কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে বিষয়টিকে দেখা হচ্ছে তার উপর। মানবজীবন সস্তা নাকি দামি।

Advertisement

টি এন নাইনান

শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০২১ ১৮:২০
Share:

অতিমারিতে মৃত্যু কারও নিয়ন্ত্রণাধীন নয়।

প্রতি বছর স্বাভাবিক অবস্থাতেই ভারতে ১ কোটি লোক মারা যান। গত ‘অস্বাভাবিক’ ১৪ মাসে কোভিড অতিমারির সরকারি খতিয়ান মোতাবেক ৩,৬০,০০০ মানুষ মারা গিয়েছেন। বেশির ভাগ ব্যাখ্যাকর্তাদের মতে এই পরিসংখ্যান অনেকটাই কমিয়ে বলা। আসল সংখ্যা এর দ্বিগুণ থেকে পাঁচ গুণ বেশি। যদি এই পরিসংখ্যানের তিন গুণ বেশিও ধরে নেওয়া যায়, তবে আনুমানিক ১ লক্ষ মানুষ কোভিড অতিমারিতে মারা গিয়েছেন। যা স্বাভবিক বার্ষিক মৃত্যুহারের এক দশমাংশ। অতিমারির চূড়ান্ত দশাগুলির কথা মাথায় রেখেই বলা যায়, কোভিড এই কালপর্বে দেশের মৃত্যুর দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ।

Advertisement

এই লক্ষ্যণীয় হারে মৃত্যুর ঘটনা অন্যান্য মৃত্যুর সঙ্গে তুলনীয় নয়। কোনও বিমান দুর্ঘটনা বা ১৯৮৪ সালের ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনার মতো কোনও কারখানা বিপর্যয়ের সঙ্গে এর তুলনা চলে না। ৯/১১-য় ঘটে যাওয়া আমেরিকার টুইন টাওয়ারে জঙ্গি হানায় নিহত বা কোনও রেল দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে যেমন রাষ্ট্রের তরফে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয়, কোভিডে মৃতদের ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। এটা অবধারিত ভাবে ধরে নেওয়া হয় যে, অতিমারিতে মৃত্যু কারও নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। তা কারখানা বিপর্যয়ের মতো দুর্ঘটনা থেকে চরিত্রগত ভাবে পৃথক। কিন্তু এই যুক্তি শেষ পর্যন্ত দাঁড়ায় না। এই অতিমারির ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশে গণমৃত্যুর হার বিভিন্ন। যা থেকে বোঝা যায়, প্রতিটি দেশের সরকার ভিন্ন ভিন্ন পন্থায় এই অতিমারির মোকাবিলা করেছে। বহু ক্ষেত্রেই মৃত্যুকে আটকানো যেত। সুতরাং, বেকারত্ব বা অন্য সঙ্কটের ক্ষেত্রে সরকার ক্ষতিপূরণ প্রদানের যে ধরনের পদক্ষেপ করে থাকে, কোভিডে বিপর্যস্ত পরিবারগুলির ক্ষেত্রেও তেমন করা যেত।

তেমন ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টিকে দেখলে কেমন হয়? পুরো ব্যাপারটাই নির্ভর করে কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে বিষয়টিকে দেখা হচ্ছে তার উপর। মানবজীবন সস্তা নাকি দামি। গত বছর যখন এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমান দুর্ঘটনায় পড়েছিল, তখন সংস্থার তরফে মৃত যাত্রীদের নিকটতম আত্মীয়কে ১০ লক্ষ টাকা করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এমন ক্ষেত্রে কর্তব্য নির্ধারণকারী ‘মন্ট্রিল কনভেনশন’ অন্য কথা বলে। ওই কনভেনশন অনুযায়ী বিমান দুর্ঘটনায় মৃত ব্যক্তিদের আত্মীয়দের হাতে পৌঁছনোর কথা ১.২ কোটি টাকা। এখনকার প্রেক্ষিতে বিষয়টিকে দেখলে বোঝা যায় ১৫,৩০০ জন মৃতের ক্ষতিপূরণ হওয়া উচিত ৪.৬ লক্ষ টাকা। জীবনবিমা নিগম যে পদ্ধতিতে মানুষের জীবনের মূল্য বা তাদের পরিভাষায় ‘হিউম্যান লাইফ ভ্যালু’ নির্ধারণ করে থাকে, তা এই প্রকার— একজন ৫০ বছর বয়স্ক ব্যক্তি মাসে ৩০,০০০ টাকা আয় করলে তাঁর ‘লাইফ ভ্যালু’ দাঁড়ায় প্রায় ২৬ লক্ষ টাকা।

Advertisement

এই অতিমারির ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশে গণমৃত্যুর হার বিভিন্ন।

তা হলে কোভিড অতিমারিতে মৃতদের পরিবারের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ঠিক কত? বিমান দুর্ঘটনা, ভোপালের মতো বিপর্যয় অথবা জীবনবিমা নিগমের হিসেব এবং অতিমারিতে মৃতের সরকারি খতিয়ান (প্রকৃত হিসাব যেহেতু অমিল) যে ভাবেই দেখা হোক না কেন, অতিমারিতে মৃত মানুষদের সামগ্রিক জীবনমূল্য বা ‘লাইফ ভ্যালু’ ১৬,৫০০ কোটি টাকা থেকে ৯৪ কোটি টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করবে।

এই হিসাবের উচ্চতম সীমাটি নির্ধারিত হয় আগের বছরের মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) ০.৫০ শতাংশের থেকে খানিকটা কম ধরে নিয়ে। প্রসঙ্গত, আমেরিকার সরকার ২০০১ সালের ৯/১১-র ঘটনায় নিহত (প্রায় ২৮০০ ব্যক্তি ওই ঘটনায় নিহত হন। আহত অগণন) ব্যক্তিদের পরিবারগুলিকে জিডিপি-র ০.৬৬ ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিয়েছিল। অন্য ভাবে দেখলে বলা যায়, ওই ব্যয় কিন্তু বহনযোগ্য।

কোভিডে মৃত ব্যক্তিদের সংখ্যার সঙ্গে তুলনা করলে এই পরিসংখ্যান নেহাতই নগণ্য। ক্ষতিপূরণ দিতে গেলে তা বিপুল অঙ্কে গিয়ে ঠেকবে (আবার যদি এর মধ্যে প্রাণে বাঁচলেও জীবিকা হারিয়েছেন এমন ব্যক্তিদেরও ধরা হয়)। জীবনহানি এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি— এই দু’টি বিষয় পরস্পর সংযুক্ত। যে সব দেশে অতিমারিতে বেশি মানুষ মারা গিয়েছেন, সে সব দেশের অর্থনীতিও গুরুতর বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে (ব্রিটেন এবং ব্রাজিল প্রকৃষ্ট উদাহরণ)। সে সব ক্ষেত্রে বিপর্যস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া প্রায় অসম্ভব। কোনটি ছেড়ে কোন ক্ষেত্রটিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, তা নির্ধারণ করাই দুরূহ।

এটা অবধারিত ভাবে ধরে নেওয়া হয় যে, অতিমারিতে মৃত্যু কারও নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। ছবি: রয়টার্স ও পিটিআই

ক্ষতিপূরণ দিলে সার্বিক ভাবে কিছু সদর্থক বিষয়ও দেখা যায়। ক্ষতিপূরণের সম্ভাবনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলি পরিজনের মৃত্যুর ঘটনা যথাযথ ভাবে জানাবেন। এতে মৃতের আসল সংখ্যা পাওয়া সম্ভব। সেই সঙ্গে সরকার যাতে পরিস্থিতিকে যথাযথ ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, সেই মর্মে সমাজের নিম্নতন স্তর থেকে চাপ আসে। এবং সর্বোপরি, রেল বা পথদুর্ঘটনা, শিশুমৃত্যু ইত্যাদি ক্ষেত্রে মৃত্যুহার নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকেও কোভিড অতিমারি মোকাবিলা করার শিক্ষা সাহায্য করবে। এমন সব মৃত্যুর ক্ষেত্রে ব্যয় কতটা কমিয়ে আনা যেতে পারে, তা কি ভারতের মতো দেশ শিখতে পারে না? যদি অকালে মৃত্যুর কারণে অতিরিক্ত ব্যয় মানবজীবনের অর্থনৈতিক মূল্যের থেকে কম হয়, তা যে পরিমাণ ক্ষতিপূরণই দেওয়া হোক না কেন, তাকে ব্যক্তিমানুষের দৃষ্টিতে সদর্থক ভাবেই দেখা হবে এবং তা সমাজের বৃহত্তর স্বার্থেই ব্যয় হয়েছে বলে মনে করা হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন