জীবনের নাটকও ‘ডাকঘর’ নাটকের সমান্তরালে ছোটে

সমাজের সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষেরা কি একজোট হয়ে ‘ডাকঘর’ নাটকের রাজকবিরাজ হতে পারেন না? খুলতে পারেন না অন্ধ ঘরের জানলা? লিখছেন অনির্বাণ জানাজীবনের নাটকও ‘ডাকঘর’ নাটকের সমান্তরালে ছুটে চলে। বাস্তবের অমলেরা একটু সহানুভূতির আশায় আকুল হয়ে অপেক্ষা করে। কিন্তু বাস্তব বড় কঠিন। কেউ ক্যানসার আক্রান্ত, কেউ এডস, কেউ কিডনির সমস্যায় ভুগছেন, কারও হয়েছে প্যারালাইসিস, কেউ-বা বয়সজনিত রোগে ভুগছেন।

Advertisement

অনির্বাণ জানা

শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৮ ০০:৫৮
Share:

খুব খুব ভালো, খুব ভালো কবিরাজমশাই। আমার আর কোনো অসুখ নেই, কোনো বেদনা নেই। আঃ, সব খুলে দিয়েছ—সব তারাগুলি দেখতে পাচ্ছি—অন্ধকারের ওপারকার সব তারা।’’— রাজকবিরাজ ঘরের জানালাগুলো খুলে দেওয়ার পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলেছিল অমল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’ নাটকে। অমল ডাক্তারবাবুদের ভাষায় টার্মিনালি ইল পেশেন্ট। প্রান্তিক ভাবে অসুস্থ রোগী। কতটা প্রান্তিক? জানা গিয়েছে, তার রোগ আর সারবে না। রোগ সারবে না এই জানা তথ্যটুকুর বাইরে আরও অনেক তথ্য আছে। আছে দইওয়ালা, সুধা আছে, রাজকবিরাজ আছে, পঞ্চানন মোড়ল, মাধববাবু, ঠাকুরদা, বেশ কিছু বাচ্চা বন্ধু— সবার চেষ্টা আছে অমলের কষ্টটাকে ভুলিয়ে রাখার।

Advertisement

জীবনের নাটকও ‘ডাকঘর’ নাটকের সমান্তরালে ছুটে চলে। বাস্তবের অমলেরা একটু সহানুভূতির আশায় আকুল হয়ে অপেক্ষা করে। কিন্তু বাস্তব বড় কঠিন। কেউ ক্যানসার আক্রান্ত, কেউ এডস, কেউ কিডনির সমস্যায় ভুগছেন, কারও হয়েছে প্যারালাইসিস, কেউ-বা বয়সজনিত রোগে ভুগছেন। কুড়ি বা তারও কম থেকে আশি বা নব্বই বছরের মানুষজন— সকলে। এই সব রোগী আর সুস্থ হবেন না। কিন্তু কিছুটা ব্যথার উপশম, নিজের কাজ করতে পারা আর কিছুটা মানুষের সাহচর্য ও সহানুভূতির আশা তাঁরা তো করতেই পারেন। নিরাময় না পাওয়া গেলেও কষ্টের উপশম তো হবে! উপশম বা ‘প্যালিয়েশন’ চিকিৎসা বিদ্যার এক জরুরি অংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী প্যালিয়েটিভ কেয়ার হল— “It is an approach that improves the quality of life of patients and their families facing the problem associated with life-threatening illness, through the prevention and relief of suffering by means of early identification and impeccable assessment and treatment of pain and other problems, physical, psychosocial and spiritual.’’

প্যালিয়েটিভ কেয়ার টিমে যেমন ডাক্তার ও নার্সরা আছেন, তেমনই একটা বড় অংশে স্বেচ্ছাসেবীরা থাকবেন। এই ধরনের প্রান্তিক ভাবে অসুস্থ মানুষদের কাছে একটা বড় ব্যাপার, সমাজ রোগীকে কী ভাবে দেখছে। সাধারণ মানুষ কতটা সহানুভূতি এবং সাহচর্য দিতে পারছে এই ধরনের রোগীদের। সমাজ রোগীদের পাশে আছে, এই বোধটা জাগিয়ে রাখার দায়িত্ব স্বেচ্ছাসেবীদের। একটা বড় অংশের রোগীদের ফিজিওথেরাপির প্রয়োজন হয়। মেরুদণ্ড ও মস্তিষ্কে আঘাতের কারণে বা সেরিব্রাল অ্যাটাকের পর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে কিছুটা কর্মক্ষম করে রাখতে পারেন ফিজিওথেরাপিস্টেরা।

Advertisement

এই সব অসহায় মানুষ সহজেই অন্য রোগে আক্রান্ত হন। কিছুটা প্রতিরোধক্ষমতা কম বলে আর কিছুটা ডাক্তার দেখানোর ব্যাপারে গাফিলতি থাকে বলে। সেই রোগ তাড়াতাড়ি ধরে ফেলা ও তার চিকিৎসার ভীষণই প্রয়োজন। আর প্রয়োজন যিনি রোগে ভুগছেন, তাঁর জটিলতাগুলি যতটা সম্ভব ঠেকিয়ে রাখা। প্যালিয়েটিভ কেয়ারে সেই জন্য সহৃদয় ডাক্তার এবং নার্সের প্রয়োজন পড়ে।

প্রয়োজন রয়েছে অর্থেরও। ওয়াকিং স্টিক, হুইল চেয়ার, ফিজিওথেরাপির যন্ত্রপাতি, ওষুধ নিয়ম করে জোগান দেওয়া— অর্থের প্রয়োজন তো আছেই। কেমোথেরাপি বা ডায়ালিসিসের কোর্স ঠিকঠাক ভাবে চলাটাও নজর রাখা উচিত।

নদিয়া জেলার পূর্বতন জেলাশাসক ড. পি বি সালিম এসেছিলেন কেরালা থেকে। সেখানকার প্যালিয়েটিভ কেয়ার সোসাইটির কাজকর্ম দেখে উৎসাহিত হয়ে নদিয়া জেলাতেও একটা অনুরূপ সংস্থা গড়ার পরিকল্পনা করেন তিনি। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে স্থানীয় কিছু চিকিৎসক ও বিভিন্ন পেশায় যুক্ত মানুষদের নিয়ে তৈরি হয় ‘সঞ্জীবনী প্যালিয়েটিভ কেয়ার সোসাইটি, নদিয়া’।

গুরুত্ব অনুযায়ী রোগীদের তিন ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়। ঠিক হয়— কিছু রোগীকে নিয়ম করে ডাক্তারেরা দেখবেন, কিছু রোগীকে নার্স এবং কিছু রোগীকে স্বেচ্ছাসেবকেরা দেখবেন। জেলা এবং ইউনিট স্তরে নিয়মিত মিটিংয়ের মাধ্যমে কাজের সমন্বয় রাখা হবে। কেনা হয় একাধিক অ্যাম্বুল্যান্স। চাপড়া, দোগাছি, দিগনগর, কৃষ্ণনগর, বগুলা, বাদকুল্লা ও বাহাদুরপুরে সঞ্জীবনীর ইউনিট রয়েছে।

শুধু একটা জেলায় সঞ্জীবনী নয়, দেশের প্রতিটি অংশে সঞ্জীবনীর শাখা মেলে দেওয়া উচিত। কারণ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আশঙ্কা অনুযায়ী, ২০২০ সালের মধ্যে ক্যানসার মহামারির আকার নেবে। এর সঙ্গে যোগ হবে আনুষঙ্গিক প্রান্তিক রোগ। অসহায় মানুষগুলোর পাশে থাকার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

বাস্তব জীবনের অনেক অমল অনেক কষ্ট নিয়ে শেষ দিনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের অন্ধকার দিনগুলো কাটে একটু আলোর আশায়। সমাজের সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষেরা কি একজোট হয়ে ‘ডাকঘর’ নাটকের রাজকবিরাজ হতে পারেন না? খুলে দিতে পারেন না অন্ধ ঘরের দরজা-জানলাগুলো? একটু আলো পেলে হয়তো অমলদের শেষ দিনগুলোয় কষ্ট কিছুটা হলেও কমতে পারত।

(উদ্ধৃতির ভিতরের অংশে বানান অপরিবর্তিত)

নদিয়া জেলা হাসপাতালের শল্যচিকিৎসক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন