অভিজিৎ দাশগুপ্তের লেখা ‘এ ভাবে বিশ্ববিদ্যালয় হয় না’ (২৩-৫) পড়ে আশ্চর্য বোধ করেছি। এ রকম লেখা শ্রীদাশগুপ্তের মতো অভিজ্ঞ সমাজবিজ্ঞানীর থেকে একেবারেই অপ্রত্যাশিত। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কলকাতার দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে ক্রমাগত সমালোচনা চলতেই থাকে। এই নিরন্তর আক্রমণে বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপাঠনের পরিবেশ দূষিত হয়। অধ্যাপক হিসেবে আমার খারাপ লাগে। কিন্তু এই সব সমালোচনার বিশ্লেষণ বা উত্তর দেওয়ার ইচ্ছে আগে হয়ে থাকলেও, কখনও সরাসরি লিখিনি। আজ লিখছি, তার একটা বড় কারণ হল, শ্রীদাশগুপ্তের লেখায় প্রেসিডেন্সির সমাজতত্ত্ব বিভাগকে নিয়ে এমন অনেক বক্তব্য আছে যেগুলোর ভিত্তিহীনতা সাধারণ পাঠকের কাছে তুলে ধরা দরকার। এই বিভাগের গোড়াপত্তনের সময় থেকেই আমি এখানে অধ্যাপনা করছি। তাই বিভাগীয় পাঠ্যক্রম (যা শ্রীদাশগুপ্তের সমালোচনার মূল বিষয়) এবং তার গঠনের ইতিহাস— সবই আমি কাছ থেকে দেখেছি।
২০১৩ সালে আমাদের বিভাগে একটি দীর্ঘ ‘অ্যাকাডেমিক ওয়ার্কশপ’-এর মধ্য দিয়ে এই পাঠ্যক্রমটি গঠিত হয়। সেই কর্মশালায় আমাদের বিভাগীয় অধ্যাপকরা দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমন্ত্রিত সমাজতত্ত্বের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসে খুঁটিয়ে আলোচনা করে এই পাঠ্যক্রম তৈরি করেন। সেই আলোচনায় আমি ছিলাম। সেখানে (বিশেষজ্ঞ রূপে) শ্রীদাশগুপ্তও ছিলেন। এবং এই পাঠ্যক্রম, যাকে তিনি জটিল, অর্থহীন, ভ্রান্ত বলে চিহ্নিত করেছেন, সেই পাঠ্যক্রমকে তিনি (অন্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে) অনুমোদন করেছিলেন।
পাঠ্যক্রমের কিছু বিষয়কে শ্রীদাশগুপ্ত জটিল, এমনকী অর্থহীন বলেছেন এবং দাবি করেছেন যে স্নাতক স্তরে কোথাও সে সব পড়ানো হয় না। একটু গুগল করলেই জানা যাবে যে এই বিষয়গুলি দেশে বিদেশে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই সমাজতত্ত্বের স্নাতক স্তরে পাঠ্য। তা ছাড়া, আমাদের পাঠ্যক্রমে এমন কিছুও থাকতে পারে যা আর অন্য কোথাও পড়ানো হয় না, সেগুলোর যৌক্তিকতা বা মান যাচাইয়ের মানদণ্ড কখনওই শুধুমাত্র এটা হতে পারে না যে, কতকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে সেগুলো পাঠ্যরূপে ব্যবহৃত হয়। তিনি আমাদের পাঠ্যক্রমের যে বইগুলোকে জটিল বলেছেন, সেগুলো গভীর চিন্তার বিশ্ববিশ্রুত নিদর্শন। নিঃসন্দেহে এতে কিছু জটিলতা আছে। কিন্তু মননশীল ছাত্রছাত্রীদের এই সব চিন্তার উপাদান না দিয়ে সরলীকরণের দাবি মেনে নেওয়া হবে কেন? আমাদের বিভাগের পঠনপাঠনের মান, ছাত্রছাত্রীদের যোগ্যতা ও উৎসাহ এবং দেশবিদেশের বহু খ্যাতনামা পণ্ডিতের মূল্যায়ন আমাদের বুঝিয়েছে যে, এই পাঠ্যক্রমে গভীর চিন্তার ফসল ফলছে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবার্ষিকী প্রকাশনার প্রশংসা করে শ্রীদাশগুপ্ত আক্ষেপ করেছেন, প্রেসিডেন্সির দ্বিশতবর্ষে এ রকম কিছু পাওয়া গেল না। এটাও ঠিক নয়। প্রেসিডেন্সির দ্বিশতবর্ষের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনই হয় এ রকম একটি প্রকাশনা দিয়ে, যাতে এই প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস নিয়ে বহু মূল্যবান প্রবন্ধ, তথ্য এবং ছবি আছে। বইটির সম্পাদক ছিলেন স্বপন চক্রবর্তী।
শ্রীদাশগুপ্ত তাঁর লেখার শেষে বলেছেন, সারা দেশে উচ্চশিক্ষা চলছে জটিল সমস্যার মধ্য দিয়ে। ঠিক ভাবনা, কিন্তু সেই ‘জটিল সমস্যা’র অন্যতম কারণ হল উচ্চশিক্ষার রাজনীতিকরণ। এই রাজনীতিকরণ খুব তীব্র ভাবে আঘাত করছে উচ্চশিক্ষার অন্দরমহলে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নির্বাচনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। আমরা জানি ইদানীং কী ভাবে বিশেষজ্ঞদের মত অমান্য করে উপাচার্যরা দেশের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কেবলমাত্র রাজনৈতিক স্বার্থ অনুসারে শিক্ষক নির্বাচন করছেন। সেই নিরিখে প্রেসিডেন্সিতে যে উপাচার্য শিক্ষক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অনুপস্থিত থাকেন, সে তো অত্যন্ত স্বস্তির কথা। অথচ শ্রীদাশগুপ্তের এতেও আপত্তি!
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্বের শিক্ষক