সাঁজোয়া শিক্ষা

চক্ষের সম্মুখে মন্দির থাকিলেই মানুষের আস্তিক হইবার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায় কি না, তর্কের বিষয়। প্রকট ভক্তির প্রদর্শনী অনেকের হৃদয়ে বিপরীত ভাবও জাগাইয়া থাকে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০১৭ ২৩:৪৪
Share:

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রস্তাব দিলেন, ক্যাম্পাসে একটি ট্যাংক থাকিলে, তাহা দেখিয়া ছাত্রছাত্রীদের হৃদয়ে দেশভক্তি বাড়িয়া উঠিবে। হাসাহাসি আরম্ভ হইয়াছে। কেহ প্রশ্ন তুলিয়াছেন, চক্ষের সম্মুখে জাজ্বল্যমান সামরিক অস্ত্রশস্ত্র না সাজাইয়া রাখিলে কি দেশবাসীর মনে দেশের প্রতি ভালবাসা জাগে না? গত বৎসর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের একটি সভায়, তৎকালীন মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির নেতৃত্বে, প্রস্তাব লওয়া হইয়াছিল: বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সতত জাতীয় পতাকা উড্ডীন থাকিবে, ২০৭ ফুট উচ্চতায়। এই বৎসর মে মাসে মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের পক্ষ হইতে ‘বিদ্যা বীরতা অভিযান’ হইয়াছে, যাহার অঙ্গ হিসাবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে একটি দেওয়াল জুড়িয়া পরম বীর চক্র প্রাপক সৈন্যদের ছবি রাখিবার কথা বলা হইয়াছে। বুঝা যাইতেছে, এক জন উপাচার্যের চকিত চিন্তাতরঙ্গ নহে, সরকারের সচেতন প্রকল্প হইল, ক্যাম্পাসে দেশীয় চিহ্ন ঝলসাইয়া ছাত্রছাত্রীদের দেশভক্তির পথে আনিবার প্রচেষ্টা করা হইবে।

Advertisement

চক্ষের সম্মুখে মন্দির থাকিলেই মানুষের আস্তিক হইবার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায় কি না, তর্কের বিষয়। প্রকট ভক্তির প্রদর্শনী অনেকের হৃদয়ে বিপরীত ভাবও জাগাইয়া থাকে। নিরন্তর সম্মুখে দেশের প্রতীক টাঙাইয়া রাখিলে কেবল সেই কারণেই অনেকে দেশের উপর রাগিয়া উঠিতে পারে, বাধ্যতা মানুষকে বিষম বিরাগের প্রতি ঠেলিয়া লইয়া যায়। একখানি জগদ্দল ট্যাংক মানুষের মনে ভক্তির পরিবর্তে ভয়ের জন্মও দিতে পারে। সচেতন ছাত্রদের মনে পড়িতে পারে, তিয়েন-আন-মেন স্কোয়ারের ছাত্র-নিষ্পেষক ট্যাংকের কথা। রাষ্ট্র যে কেবল লালন করে না, বিলক্ষণ শাসন করে, তাহা জ্ঞাপন করিবার তর্জনী ক্লাসে যাইবার পথে চিরজাগরূক হইলে, দেশের প্রতি বাহ্যিক আনুগত্য ও আন্তরিক বিতৃষ্ণা জাগিয়া উঠাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাহা অপেক্ষা জরুরি কথা: দেশ বলিতে কেবল কতকগুলি চিহ্ন বুঝায় না, দেশ বলিতে বুঝায় তাহার মানুষ, তাহাদের নানা মত, সেই মত প্রকাশের স্বাধীনতা। যে দেশ নাগরিকের মতামতকে কঠোর নিয়ন্ত্রণ করিতে উৎসাহী, নাগরিকের বক্ষের উপর চাপিয়া আস্ফালন ও মুহুর্মুহু স্বঘোষণার দ্বারা নিজেকে মহিমময় বলিয়া প্রমাণ করিতে উৎসাহী, সে দেশ খুব পরিণতমনস্ক নহে। কারণ দেশ ও দেশবাসীর মধ্যে প্রভু-প্রজা সম্পর্ক নাই, দেশ ও দেশবাসী স্বতন্ত্র নহে।

আসলে, বর্তমান সরকার নিজেকে দেশের সহিত গুলাইয়া ফেলিয়াছেন। সরকার-বিরোধিতাকে রাষ্ট্রদ্রোহ বলিয়া প্রচার করিতেছেন। বিরোধী স্বরকে আবশ্যিক ভাবে দেশঘাতী বলিয়া দাগিয়া দিতে পারিলে, মৌরসিপাট্টা গাড়িবার সুবিধা ঘটে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মানুষের হৃদয়কে উর্বর করিয়া তুলে, তাহাকে বহুমাত্রিক ধ্যানধারণার সহিত পরিচিত করায়। প্রণব মুখোপাধ্যায় রাষ্ট্রপতি ভবন হইতে বিদায়ের লগ্নে বলিয়াছেন, শৃঙ্খলাচ্যুতিকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নিয়ম বলিয়া গ্রহণ করিতে শিখিতে হইবে। বলিয়াছেন, আমরা কিছু ভাবনার সহিত একমত না-ই হইতে পারি, কিন্তু তাহা বলিয়া চিন্তার বহুত্বকে অস্বীকার করিতে পারি না, তাহা হইলে আমাদের চিন্তাপ্রক্রিয়ার এক মৌলিক চরিত্রই ক্ষয়প্রাপ্ত হইবে। হয়তো এই সাবধানবাণী গণতান্ত্রিক দেশের সেই শক্তিগুলিরই বিরুদ্ধে, যাহা সকলের মতকে এক ছাঁচে ঢালিয়া ফেলিতে চাহিতেছে। শিক্ষা মানুষকে শিখাইবে অস্বীকার। শিখাইবে প্রশ্ন তুলিতে, প্রথাকে বিব্রত করিতে, বিরুদ্ধে যাইবার সাহস সংগ্রহ করিতে। দেশকে কেন প্রশ্নাতীত ভক্তির স্থলে রাখিব, এই প্রশ্ন করিবার অধিকারকেও সম্মান করিতে শিখাইবে যথার্থ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ট্যাঙ্ক আনিয়া সেই সম্ভাবনাকে দুরমুশ করিতে চাহিলে, তাহা হইবে কর্তৃপক্ষের অশিক্ষার প্রকাশ।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন