করোনা আবহের মধ্যেই ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ‘আমপান’। সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে বিপদের আশঙ্কা রয়েছে সাগর কিনারে। জারি হয়েছে অশনি সঙ্কেত। এমনি সময়ে আকাশ কালো মেঘে ঢাকতে না ঢাকতেই মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে ওঠে ‘মা কলিং’। আর যদি তা কখনও না ওঠে তা হলে জানতে হবে যে মানুষটা ঝড় জলের সময় সবার মাঝে ঘরের মধ্যে অস্থির পায়চারি করছে শুধুমাত্র আমার ঘরে ফেরার অপেক্ষায়, তিনি আমার মা। যারা বাইরে থাকব ঝড়ের সময় তারা যেন নিরাপদ আশ্রয়ে থাকি সেই প্রার্থনায়।
বলছিলেন নিভাদেবী। আমার মায়ের থেকে বয়সে ঢের বড়, এককালে লালগোলার বাসিন্দা নিভা সমাজদার। বৃদ্ধ কার্তিক সরকারের কথায়, “একমাত্র নিরাপদ আশ্রয় মায়ের কোল। সেখানে বাকি যা কিছু সবই তো অনিশ্চিত আশ্রয়।” কথাটা শুনে হাসলেন নিভাদি। মতামতকে সমর্থন জানিয়ে বললেন “তা ঠিক বলেছো। একমাত্র মায়েদের কাছে “ মা খেতে দাও” এর মতো অমোঘ ও নিশ্চিন্ত আব্দার আর কোথাও যে নেই। সে আমার মা’ই হোক আর তোমার মা’ই হোক।” বলতে বলতে পাশের ঘরে উঠে গেলেন ‘মাস্ক’ আনতে। ভাগীরথীর পশ্চিম পাড়ের যে সাদা বাড়িতে নিভাদি’র মতো কয়েকজন মানুষের বার্ধক্য যাপন সেই বাড়ির নাম “আনন্দ নিকেতন”। জেলার একমাত্র বৃদ্ধাশ্রম। আক্ষরিক অর্থেই নিভৃতবাস।
তাঁদের বয়স হয়েছে ঢের। কেউ কানে কম শোনেন, কারোর চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে গিয়েছে বহুদিন আগেই। সাদা বাড়িটার প্রত্যেক ঘরে দুজন করে মোট বারোজন বৃদ্ধ বৃদ্ধার অনন্ত অবসর কাটে এই আনন্দ নিকেতনেই। শুধু মুর্শিদাবাদ নয় প্রতিবেশী নদিয়া, বীরভূমের কয়েকজন বয়স্ক মানুষের বাস এই আশ্রম বাড়িতেই। সেখানেই সমবয়সীদের সঙ্গে দিনরাত গল্পগুজব করে আড্ডা দিয়ে, কখনও বই পড়ে কখনও আবার ফেলে আসা সংসারের স্মৃতিচারণেই কেটে যায় তিন প্রহর অমিয়া স্যান্যাল, ভারতী বাগচীদের। এটাই চেনা ছবি।
করোনা আতঙ্কে সতর্কতা বেড়েছে আশ্রমে। ঘরে বাইরে ঝুলেছে একাধিক তালা। দু’একজনের ব্যঙ্ক বা জরুরি কাজে টুকটাক বাইরে যাওয়া ছাড়া ছেদ পড়েনি নির্ভেজাল দিন যাপনে। বিধি মেনে মাস্ক দিয়ে মুখ বন্ধ করে নিজেদের সতর্ক রেখেছেন প্রৌঢ়রা।
“এ আর নতুন কী! মুখে আগল দিয়েই তো আছি বহুকাল,” রসিকতার ছলে বললেন প্রাক্তন সরকারি কর্মী কার্তিকবাবু। আগল খুলে মাঝে মধ্যেই বেরিয়ে পরে আবেগ। সামনের পার্কে খেলা করা শিশুদের দেখে মনে পড়ে যায় নিজেদের ফুটফুটে নাতি নাতনির কথা। তার হাত ধরেই মনে পড়ে যায় নিজের ছেলে মেয়েদের কথা। মুহুর্তে মুছে যাওয়া দিনগুলো পরিষ্কার হয়ে ওঠে সামনে ঝকঝকে দিনের মতো। মনখারাপ করে। একলা জানালায় দাঁড়িয়ে চোখ চলে যায় ভাগীরথী পার করে কোন সুদুরে, খেয়ালও থাকে না। আবার হঠাৎ মেঘ এসে কেন যে ফিরিয়ে আনে এই একলা ঘরের নিরালা দুপুরে তা বুঝে পান না অমিয়া সান্যাল।
তাঁদের কেউ কেউ সরকারি চাকরি করতেন। চাকরি শেষের উপার্জনের একটা অংশ ভাগ করে দিয়েছেন নিকটাত্মীয়দের কাউকে কাউকে। কেউ আবার পুরোটাই জমিয়ে রেখেছেন ব্যঙ্কে। খুঁটে খুঁটে খেতে হবে যতদিন দেহে আছে প্রাণ এই আশায়। সমাজকল্যাণ দফতেরর প্রাক্তন কর্মী ভারতী বাগচীর চাকরির বেশিরভাগ সময় কেটেছে হয় ভাড়া বাড়িতে না হয় সরকারি আবাসনে। সেখানেই তাঁর সঙ্গে থাকতেন মা , বাবা, ভাই বোন সকলেই। অবসরের একদিন আগে মা মারা যান। অবসরের পর একলা কিছুদিন বাড়ি ভাড়ায় থাকতেন দিদির বাড়ির কাছেই। তারপর ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে এলেন এই ‘আনন্দনিকেতন’এ।
ভারতীদেবী বলছেন, “এখানকার পরিবেশটা ভাল লেগে গিয়েছে। দু চারদিন নিকটাত্মীয়ের বাড়ি ঘুরে আসি মনখারাপ করলে তবে তা বেশিদিনের জন্য কখনই নয়।” ‘স্বাধীনভাবে বাঁচার স্বাদ যে আলাদা’ বলছেন তিনি। এখানে স্বামী গিরিজাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে এসেছেন বীরভূমের নন্দিতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নন্দিতা দেবী বলছেন, “ওঁর ভাল লেগেছিল ভাগীরথীর পাশের শহর বহরমপুর। ইন্দ্রপ্রস্থের বাড়ি করে এখানেই থাকতাম দুজনে। সেখানে কিডনির সমস্যা ধরা পরে। ছেলেমেয়েরা বাইরে থাকায় অতবড় বাড়ি একা সামলাতে পারছিলাম না। তাই বিক্রি করে ছেলেমেয়েদের ভাগ করে নিজের জন্য কিছু রেখে এখানেই পাকাপাকি উঠে এসেছিলাম দুজনে।” বছর তিনেক আগে মারা গিয়েছেন গিরিজাবাবু। এই আশ্রমেই তাঁর পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম করেছিলেন বলে জানান তিনি।
করোনা সংক্রমণ থেকে বাঁচতে দেশজুড়ে পঞ্চাশদিন লকডাউনের ফলে বন্ধ হয়ে গিয়েছে অনেকের ছেলেমেয়ে কিংবা জামাইয়ের ব্যবসা, কারও রোজগারও। তারা কি করে কি করছে ফোনেই সেই খোঁজ নিচ্ছেন কেউ, কারও সেই সুযোগটুকুও নেই। ছেলে মেয়ে ফোন করেছিল কেউ আপনাকে? প্রশ্ন শুনে ভাঙা গালে এক মুখ হাসেন নিভা সমাজদার।