সিধুর ফাঁসি আটকাতে দর্শক বিক্ষোভ, পলাতক ইংরেজ

এক সময় ‘কলকাতার চিৎপুর’ নামে পরিচিত ছিল। বহু যাত্রাদল এবং শিল্পীর জন্ম দিয়েছে। সময়ের সঙ্গে যাত্রায় আগ্রহ কমেছে। কী অবস্থায় বেলদার যাত্রার? খোঁজ নিলেন বিশ্বসিন্ধু দেএক সময় ‘কলকাতার চিৎপুর’ নামে পরিচিত ছিল। বহু যাত্রাদল এবং শিল্পীর জন্ম দিয়েছে। সময়ের সঙ্গে যাত্রায় আগ্রহ কমেছে। কী অবস্থায় বেলদার যাত্রার?

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০১:২৬
Share:

এখন: বেলদায় বিভিন্ন যাত্রার পোস্টার। —নিজস্ব চিত্র।

সে সোশ্যাল মিডিয়ার আগের যুগের কথা। গ্রামাঞ্চলের দু’একটি মাঠ সারা রাজ্যে পরিচিত ছিল। শুধু যাত্রার কল্যাণে। কারণ শীত হলেই সেখানে পাল খাটিয়ে যাত্রা হত। তার আগে রেডিয়োয় অপেরা পার্টিগুলো বিজ্ঞাপন দিত, অমুক দিনে অমুক বিদ্যালয় বা বিডিও সংলগ্ন মাঠে হবে যাত্রা। সেই উন্মদনার দিনগুলোতেই বেলদায় শুরু হয়েছিল যাত্রা। বেলদা হয়ে ওঠে ‘কলকাতার চিৎপুর’।

Advertisement

বেলদায় ১৯৬০ সালে জিতেন্দ্রনাথ দাসের হাত ধরে যাত্রাদলের চলা শুরু। তিনি প্রথম প্রযোজক ও যাত্রাদল ‘শিল্পীচক্র’-এর প্রতিষ্ঠাতা। যাত্রার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বেলদার নাট্য ব্যক্তিত্ব প্রিয়ব্রত মিশ্র, দেবব্রত মিশ্র, যুগজিৎ নন্দ প্রমুখ। তখন যাত্রা হত চারটি খুঁটি আর পাল খাটিয়ে। সঙ্গে হ্যারিকেন লাইট। বেলদার পাশাপাশি দাঁতনেও যাত্রা দল গড়ে উঠেছিল। একজন মালিকের ভাবনা ভেঙে দিয়ে সেখানে যাত্রাদলের পাঁচজন মালিক ছিলেন। দাঁতনের সরিপুরে নিউ চণ্ডী অপেরা ১৯৬২ সাল থেকে পনের বছর যাত্রা পরিবেশন করেছে। কিশোরী সাউ, গৌর পট্টনায়ক, কেদার দাস, গোষ্ঠ নন্দী, রমেন দাস এই পাঁচবন্ধু যাত্রাদল গড়ে তোলেন। ১৯৭৭ সালে কেশিয়াড়ির কুকাইতে সাঁওতালি যাত্রাদল তৈরি হয়। প্রথম দলটির নাম সেঙেল অপেরা। অর্থ আগুন যাত্রা। যাত্রাশিল্পী রঞ্জন জানা বলেন, ‘‘কলকাতার চিৎপুর নামে খ্যাত বেলদাতে তখনকার নামকরা যাত্রা দলের তালিকাটা বেশ দীর্ঘ।’’

বেলদা বহু যাত্রাশিল্পী, নির্দেশক ও পরিচালকের জন্ম দিয়েছে। নাট্যতীর্থ, লোকতীর্থ, ভারতী রূপনাট্যম, মা শীতলা অপেরা, মাতৃমন্দির, পিত্রাঞ্জলি, বাসন্তী, আকাশবার্তা, আকাশবাণী, কল্পতরু, পরশমণি, নবারুণ প্রভৃতি দলের নাম ছিল। এর মধ্যে কয়েকটি এখনও লড়াই করে বেঁচে আছে। একসময় মঞ্চ দাপিয়ে অভিনয় করেছেন এবং করছেন তপন সেন, আশিস চক্রবর্তী, নির্মল মাইতি, রাঙা মিশ্র, বীরেন মাইতি, রঞ্জন জানা, উদয়ভানু জানা, বাদল জানা, মঞ্জু মাল, রেবতী সিনহা, মিনা কুমারী। কলকাতার দলে বিদিশা মহান্তি, বিপাশা মহান্তি, বিমলেন্দু ভট্টাচার্য, বাবলু পড়্যা, সুনীল কর, মিলন দাস, আশিসকুমার করণ প্রমুখ। জমজমাট মঞ্চ সফল সব যাত্রা। ‘বর্ণপরিচয়’, ‘অচল পয়সা’, ‘জেল থেকে বলছি’, ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘তালপাতার সেপাই’, ‘ধন্যি মেয়ে’। আর উন্মাদনা? সত্তরের দশকে কল্পতরু অপেরা সাঁওতাল বিদ্রোহ নিয়ে নামায় ‘বিদ্রোহী সিধুকানু’। সিধুর অভিনয়ে উদয়ভানু জানা অনবদ্য। দর্শকের মনে সত্যিকারের সিধু। যাত্রাদলের এক সদস্য অজিত শীট বলেন, ‘‘ছোটবেলায় দেখেছি ফাঁসির বিরোধিতায় শেষ দৃশ্য প্রায় করাই যায়নি। তীর-ধনুক নিয়ে সাঁওতালরা সাজঘর পর্যন্ত চলে এসেছে। কিছুতেই সিধুকে ফাঁসি দিতে দেবে না। ইংরেজ তখন সাজপোশাক ছেড়ে দে ছুট।’’ ঝাড়গ্রামের নেগুই, কেন্দুগাড়ি-সহ বিভিন্ন এলাকায় এই সমস্যায় পড়তে হয়েছে যাত্রাদলকে।

Advertisement

পশ্চিমবঙ্গের যাত্রার পীঠস্থান হিসেবে পরিচিত চিৎপুরের সঙ্গে তুলনা করা হত বেলদাকে। এখন কি সেই মর্যাদা রয়েছে? সুদিন আজ অতীত। ‘শিল্পীচক্র’এর শিল্পীরা ‘মহারাজ লক্ষ্মণ সেন’, ও ‘গরীবের মেয়ে’র পরিচর্চায় ব্যস্ত। বেলদায় ১৪টি গদি ঘর আছে। যেখান থেকে বিভিন্ন যাত্রাদল বায়না হয়। কিন্তু যাত্রার দিকে মুখ ফেরাচ্ছেন গ্রাম ও শহরের মানুষ। গদিঘরে বসেন রামপদ জানা, চন্দন জানা, প্রদীপ প্রধানেরা। তাঁরা বলেন, ‘‘বেলদাতে প্রায় দুশোটি দল আছে। কলকাতার শিল্পীরাও এদিকের দলগুলিতে যুক্ত হচ্ছেন। বেশি পালা পাচ্ছেন। পুরনো শিল্পীরা সরকারি সাহায্য তেমন পাচ্ছেন না। সরকার যাত্রা শিল্পের জন্য উদ্যোগ নিয়েছে ঠিকই।’’ যাত্রার মূল সময় তথা শিল্পীদের কথায় বড় সিজিন পৌষ সংক্রান্তি থেকে বৈশাখ মাসের শেষ পর্যন্ত। জ্যৈষ্ঠ মাস থেকে ঘরে বসে থাকতে হয় শিল্পীদের। অন্য কাজ করতে হয়। যাঁদের উপায় থাকে না তাঁদের কষ্টে দিন কাটাতে হয়। শুধু যাত্রা শিল্পী নয়, সাজঘরে যারা কাজ করেন কিংবা আলো ও যন্ত্রানুষঙ্গে তাদেরও মরা সময় কাটাতে হয়। সরকার দৃষ্টি দিক।

দলের সংখ্যা বর্তমানে বাড়লেও শিল্পীর সংকটে ভুগছে দলগুলি। নতুন শিল্পী উঠে আসছে না বলেই মত অনেকের। কারণ হিসেবে গ্রাম-বাংলা থেকে হারিয়ে যাওয়া অ্যামেচার থিয়েটার উঠে যাওয়াকেই দায়ী করছেন তাঁরা। কেশিয়াড়ির যাত্রাশিল্পী রতন সেন সিরিয়ালেও যুক্ত। যদিও এক কালের মঞ্চ কাঁপানো শিল্পীরা এখন ঘরে বসা। অনেকে সরকারি ভাতা পাননি। নতুন শিল্পী আসছেন। কিন্তু যাত্রায় ততটা দক্ষ নন। শিশু শিল্পী দলে কমছে। তারা যাত্রা শিল্পকে তেমন করে গ্রহণ করছে না। কাহিনিতেও শিশু চরিত্র রাখা হচ্ছে না। বর্তমানে নামকরা মহিলা শিল্পী সাগরিকা চট্টোপাধ্যায়, পূর্ণিমা ঘোষ, লাবণি চক্রবর্তী, কৃষ্ণা মণ্ডল প্রমুখেরা কিছুটা হলেও যাত্রার সুনাম বজায় রেখেছেন।

তবে কিছুটা আশার আলোয় দেখা যাচ্ছে। বেশ কয়েক বছর যাত্রা শিল্প মার খাচ্ছিল। যদিও গত বছর থেকে ফের বায়না পেতে শুরু করেছে দলগুলি। এখানকার দল চলে যায় দুই মেদিনীপুরের ঘাটাল, নন্দকুমার, তমলুক, দুই ২৪ পরগনা, রানিগঞ্জ, টাটা, বহড়াগোড়া, কলকাতা, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ওড়িশা-সহ বিভিন্ন জায়গায়। মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে মনোরমা, অর্কেস্ট্রা, ওড়িয়ার সাইক্লোরামা পদ্ধতির আঙ্গিক থেকে। মেদিনীপুর জেলা জাতীয়তাবাদী যাত্রা সংসদের সম্পাদক শশাঙ্কশেখর দে বলেন, ‘‘কোনও নতুন গল্প বা কাহিনি এরা দিতে পারছে না। দিনের পর দিন একই মঞ্চ, একই আলোকসজ্জা। ফলে মানুষ চটকদারি ওই মনোরমার মতো বিষয় থেকে যাত্রামুখী হচ্ছে। এখানে নতুন নতুন গল্প বা কাহিনি থাকে।’’ শিল্পী আশিসকুমার করণ বলেন, ‘‘পুরনো নাটকগুলো নতুন করে কখনও কখনও অভিনয় করা হচ্ছে। যাত্রার সুদিন বর্তমানে এলেও ভাল নাটক তৈরি হচ্ছে না।’’ পূর্ব মেদিনীপুরের নিমতৌড়ির একটি দলের অভিনেতা মিলন দাসের ক্ষোভ, ‘‘লোক শিক্ষা নয়, কিছু মানুষ লোক অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন যাত্রা শিল্পকে। লোকশিক্ষার মান কমেছে। এখন যাত্রায় আর ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়কে কেউ খুঁজে পাচ্ছি না।’’

বেলদায় ১৯৮৯ সালে গড়ে উঠেছিল মেদিনীপুর জেলা যাত্রা পরিষদ। যাত্রা পরিষদ যাত্রাশিল্প ও শিল্পীদের উন্নয়নের জন্য দু’টি কাজ করে সেসময়। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য যাত্রা উৎসবের আদলে শুরু হয় জেলা যাত্রা উৎসব। ২০০১, ২০০২ ও ২০০৬ সালে পরপর তিনটি জেলা যাত্রা উৎসব হয়েছে। পরে আর্থিক দিকের অবনতির কারণে আর যাত্রা উৎসব করতে পারেনি পরিষদ। যুগজিৎ নন্দ বলেন, ‘‘বর্তমানে যাত্রা শিল্পে আর নেই। চলচ্চিত্রের অভিনেতারা যাত্রায় এসে গ্রামীণ যাত্রা শিল্পী ও শিল্পে থাবা বসাচ্ছেন। সেই কাহিনি নেই। চটকদারিত্বে ভরেছে যাত্রা। ফলে দর্শক টানার ক্ষমতা কমছে।’’

সব বাধা কাটিয়ে তবুও কাজ করে চলেছে পরশমণি, লোকরঞ্জন, রাজধানী, সুকান্ত, রাজলক্ষ্মী, তীর্থলোক, আনন্দলোক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন