নির্বাচন কমিশন শ্রীকৃষ্ণ নহে। নরেন্দ্র মোদীকেও নেহাত দুর্জন ভিন্ন কেহ শিশুপাল বলিবেন না। অতএব, তাঁহার অপরাধ মার্জনার ঘটনা অষ্টোত্তর শতবারেই থামিবে না, মোদীর সম্ভবত ভরসা আছে। রাজীব গাঁধী সম্বন্ধে তাঁহার অবিশ্বাস্য কটূক্তি, অনুমান করা চলে, সেই ভরসারই ফল। শ্রীমোদী সেখানেই থামেন নাই। চ্যালেঞ্জ ছুড়িয়াছেন, নির্বাচনের শেষ দুই পর্বে না হয় রাজীব গাঁধীকে লইয়াই আলোচনা হউক— তিনিও দেখাইয়া দিবেন, খেলা কী করিয়া খেলিতে হয়। তাঁহার কথাটি ফলিয়া গিয়াছে, সন্দেহ নাই— নির্বাচনের ময়দান হইতে অন্তত এই মুহূর্তে অন্য প্রশ্নগুলি উধাও। কিন্তু, এই প্রথম বার, মোদী সম্ভবত নিজের জালে জড়াইয়া পড়িতেছেন। খেলাটি তাঁহার মনোমতো হইতেছে না। সমাজের বহুলাংশ উক্তিটিকে ধিক্কার জানাইয়াছে। আর, রাহুল গাঁধী শান্ত ভঙ্গিতে জানাইয়াছেন, তিনি ভালবাসার অস্ত্রে ঘৃণার সহিত লড়িবেন। রাহুলের সদিচ্ছা লইয়া প্রশ্ন তুলিবার প্রয়োজন নাই, কিন্তু তাঁহার অবস্থানটি নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক। যে নির্বাচনে শাসকপক্ষের ঘৃণার রাজনীতিই বৃহত্তম প্রশ্ন, সেখানে ভালবাসার প্রতিস্পর্ধী অবস্থানটিকে চক্ষে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দেওয়া রাজনৈতিক পরিণতমনস্কতার পরিচয়।
কেহ বলিতে পারেন, হরিয়ানার জনসভায় নরেন্দ্র মোদী যে কংগ্রেসের ‘ভালবাসার অভিধান’ প্রকাশ করিয়াছেন, তাহাই দেখাইয়া দেয়, ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় তিনি কতখানি বিচলিত। রাহুল গাঁধীর বাঁধিয়া দেওয়া প্রেম-ঘৃণার ‘বাইনারি’তে কথা বলিতে বাধ্য হইতেছেন। যে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে তাঁহাকে দেখিতে ভারত অভ্যস্ত, এই প্রথম তাহা অমিল— নরেন্দ্র মোদী ব্যাকফুটে আসিয়া বল ঠেকাইতেছেন। অনুমানটি সত্য হইতেই পারে। কিন্তু তাহাতে এই কথাটি হারাইয়া যায় না যে কুকথা তিনি একা বলেন নাই। কংগ্রেসও বলিয়াছে। রাহুল গাঁধী যতই বলুন যে তিনি ‘চৌকিদার’ বলিয়া হাঁক পাড়িলে জনতা বাকিটা বলিয়া দেয়, সত্য হইল, তিনিই প্রধানমন্ত্রীকে ‘চোর’ বলিয়াছেন। ‘চোর’ কথাটি ভারতীয় রাজনীতিতে বহুলব্যবহৃত। কিন্তু, তাহাতেও কথাটি অসাংবিধানিকই থাকিয়াছে। ইহা সত্য যে সব কুকথার ওজন সমান নহে। পূর্বসূরি প্রধানমন্ত্রীকে ‘ভ্রষ্টাচারী নম্বর এক’ অথবা ‘দেহাতি অওরত’ বলা, আর বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে আওরঙ্গজেব বা হিটলারের সহিত তুলনা করা চরিত্রগত ভাবে এক কথা নহে। ইহাও সত্য যে একা নরেন্দ্র মোদী যত কুকথা বলিয়াছেন, কংগ্রেসের শীর্ষনেতারা সামগ্রিক ভাবে তত বলেন নাই। কিন্তু, কোনও যুক্তিতেই যে কথাটি পাল্টাইবার নহে, তাহা হইল: ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন কদর্যতার পাঁকে নিমজ্জিত। এবং, তাহাতে সব পক্ষেরই দায় কম-বেশি।
তবু প্রশ্ন, দেশের শীর্ষ আসনে অধিষ্ঠিত নেতা কেন এতখানি নীচে নামিলেন? শুধুই কদর্যতাকে অতিক্রম করিবার মতো মানসিক প্রশস্তির অভাব? শুধুই ঘৃণা উগরাইয়া দেওয়ার রাজনীতির তাগিদ আর ক্ষুদ্রতার কক্ষপথে ঘুরিয়া চলার কু-অভ্যাস? না কি, নির্বাচনের প্রতিটি পর্ব তাঁহাকে আরও মরিয়া করিয়া তুলিতেছে? তিনি বুঝিতেছেন, পাঁচ বৎসরে তিনি এমন একটিও সাফল্য অর্জন করিতে পারেন নাই, যাহার জোরে তিনি ভোট চাহিতে পারেন, এবং পাইতেও পারেন? গোটা প্রচারে তিনি নোট বাতিলের প্রসঙ্গ তোলেন নাই। জিএসটি বিষয়েও তিনি নীরব। এক বারও জানান নাই, তাঁহার সাধের মেক ইন ইন্ডিয়া বা স্টার্ট আপ ইন্ডিয়ার শেষ অবধি কী হইল। তিনি কর্মসংস্থানের কথা বলেন নাই, জিডিপির বৃদ্ধির প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন নাই, এমনকি কৃষকের উন্নতিসাধনের মহতী সঙ্কল্পও আর তাঁহার মুখে শোনা যায় নাই। উগ্র হিন্দুত্ব, তীব্র বিদ্বেষ, সাঙাততন্ত্রের পুষ্টিসাধন ভিন্ন আর বিশেষ কোনও সাফল্য তাঁহার নাই বলিয়াই কি নরেন্দ্র মোদী মরিয়া? কোনও অতলে নামিতেই তাঁহার আর বাধিতেছে না?