স্ট্র্যাটেজি করা আর মাঠে নেমে গোল করার মধ্যে বিস্তর ফারাক

বড়জোর কাদা ছেটাবেন

অনেকের ধারণা, ‘বিদ্রোহী’ মুকুল রায় তৃণমূলের শিরঃপীড়ার কারণ। দলের রক্তচাপ বাড়িয়ে দেওয়ার মতো কিছু টোটকা-তাবিজ হয়তো তাঁর ঝুলিতে আছে।

Advertisement

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৭ ০৬:১০
Share:

ঘোষণাটি আচমকা। তবে অপ্রত্যাশিত নয়। দলের মধ্যে তাঁকে ক্রমশ গুরুত্বহীন করে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছিল বেশ কিছু দিন। তিনিও দূরত্ব বাড়িয়ে বিরাগ উসকে দিচ্ছিলেন। দেখার ছিল, মুকুল নিজে ঝরে, না শাখা থেকে ছিঁড়ে ফেলা হয় তাকে। শেষ পর্যন্ত মুকুল রায় নিজেই আগে তৃণমূল ছাড়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন। তার পরেই দলও তাঁকে সাসপেন্ড করল। এখন অপেক্ষা আনুষ্ঠানিক বহিষ্কারের।

Advertisement

মুখবন্ধের এই প্রেক্ষাপট সবার জানা হয়ে গিয়েছে। এখন জল্পনা মুকুলের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে। তিনি কি বিজেপি-তে যোগ দেবেন? না কি নিজেই তৃণমূল ভেঙে নতুন দল বা মঞ্চ গড়ে এই রাজ্যে বিজেপি-কে মদত দেবেন? আপাতত সবার কাছে এটাই বড় প্রশ্ন। সেইসঙ্গেই প্রশ্ন, মুকুল সত্যিই তৃণমূলের কতটা ক্ষতি করার মতো ক্ষমতা রাখেন?

অনেকের ধারণা, ‘বিদ্রোহী’ মুকুল রায় তৃণমূলের শিরঃপীড়ার কারণ। দলের রক্তচাপ বাড়িয়ে দেওয়ার মতো কিছু টোটকা-তাবিজ হয়তো তাঁর ঝুলিতে আছে। কিন্তু দলকে ঘায়েল করার ‘শক্তিশেল’ পাঞ্জাবির পকেটে নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তেমন ভাবার কোনও কারণ আছে কি? উত্তর খুঁজতে হলে এক বার পিছু ফিরে দেখা জরুরি।

Advertisement

সন্দেহ নেই, তৃণমূলের বেড়ে ওঠার বিভিন্ন পর্বে মুকুল ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অতি নির্ভরযোগ্য সেনাপতি। দলের সাংগঠনিক কাঠামো নির্মাণে তাঁর ভূমিকা সেই সময় ছিল কার্যত অপরিহার্য। নিরলস পরিশ্রম ও দক্ষতায় তিনি দলকে সুসংবদ্ধ করার কাজ করে গিয়েছেন। জেলায় জেলায় নিচুতলা পর্যন্ত লোক বাছাই করে উপযুক্ত দায়িত্ব দিয়েছেন। দলের নির্বাচনী রণকৌশল তৈরি করেছেন। আবার দলের ভাঁড়ারও সামলেছেন।

আসলে মমতার সবচেয়ে বিশ্বস্ত ছায়াসঙ্গী হিসেবে দলে পূর্ণ কর্তৃত্ব বলতে যা বোঝায়, দীর্ঘ সময় মুকুলের তা ছিল। তাঁর কথাই এক সময় সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের কাছে শেষ কথা বলে গণ্য হত। মমতা সেই পরিসর মুকুলকে দিয়েছিলেন। অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়তো নেত্রী পর্যন্ত পৌঁছনোর আগে মুকুল রায়ের টেবিলেই চূড়ান্ত হয়ে যেত। পার্টির সর্বস্তরের লোকজন ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় এ সব প্রশ্নাতীতভাবে মেনে নিয়েছিল।

আবার মুকুলের সঙ্গে দল যখন ক্রমশ দূরত্ব বাড়াতে থাকে, এই মুকুল রায়কেই কিন্তু তখন দলে নিঃসঙ্গ দিন কাটাতে হয়েছে। যাঁর কুশলতায় তৃণমূলের সংগঠন বহুলাংশে সুসংবদ্ধ হয়েছে বলে মনে করা হয়, যাঁর অঙ্গুলিহেলনে কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ পর্যন্ত দলের সাংগঠনিক কাঠামো নড়ে উঠত বলে দাবি, ক্ষমতা খর্ব হওয়ার পরে সেই মুকুলের পাশে দাঁড়ানোর জন্য দলের কোনও উল্লেখযোগ্য পদাধিকারীকে এখনও পর্যন্ত দেখা যায়নি। তাই আজ মুকুল তৃণমূল ছেড়ে এলে সহসা সেই দল থেকে মমতা-সমর্থকরা তাঁর ছাতার তলায় এসে ভিড় করবেন— এ স্বপ্নের বাস্তব ভিত্তি দুর্বল।

মুকুলের সর্বময় কর্তৃত্ব যে খর্ব হচ্ছে তার আভাস কিন্তু মিলেছিল ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনের কিছু আগে। ২০১৪-র ভোটে জিতে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লোকসভায় পদার্পণ ও দলের যুব নেতা হিসেবে দ্রুত উত্থান ভিতর থেকে মুকুলের কর্তৃত্বে চিড় ধরায়। মুখে প্রকাশ না থাকলেও যুব সভাপতি পদে অভিষেকের অভিষেক মুকুলকে খুশি করেনি। দলের গায়ে তত দিনে চিটফান্ড কেলেঙ্কারির কালি লেগে গিয়েছে। আঙুল উঠেছে সততার দিকে। আর সেই সব কেলেঙ্কারির কুশীলবদের সঙ্গে মুকুল রায়ের ঘনিষ্ঠ ওঠবোসের কথাও ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বাসযোগ্যভাবে। এমনকি নানা মহলে ছড়িয়ে পড়েছে বিতর্কিত ডেলো বৈঠকের কাহিনি।

চিটফান্ড নিয়ে সিবিআই মুকুলকে ডাকে ২০১৪ সালের অক্টোবরে। জেরার পরে হাসিমুখে বেরিয়ে আসেন তিনি। তাঁর প্রতি বিশ্বাসের ফাটল আরও চওড়া হতে থাকে। মুকুলও ঘনিষ্ঠ কয়েক জন বিধায়ককে নিয়ে দল ভাঙার চেষ্টায় মাতেন। তাঁর প্রচ্ছন্ন মদতে ন্যাশনালিস্ট তৃণমূল কংগ্রেস গঠনের তোড়জোড় শুরু হয়। কিন্তু সেই উদ্যোগও হালে পানি পায়নি। এমনকি সে দিনের মুকুল-ঘনিষ্ঠ বিধায়করাও অচিরে মূল স্রোতে ফিরে আসেন।

এত কিছুর পরেও ২০১৫ সালে দিল্লিতে ডিনার টেবিলে উপস্থিত সাংবাদিকদের সামনে হঠাৎ মুকুলকে হাজির করে মমতা আবার নতুন কিছুর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তৃণমূলের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই সে দিন প্রমাদ গুনে বলাবলি শুরু করেছিলেন, ‘‘আবার!’’ তাঁদের সেই বিপন্ন বিস্ময় মমতা জানতেন না, তা নয়। কানে তোলেননি। অল্প অল্প করে দলের কাজে মুকুলকে ব্যবহার করা শুরু হয়। সর্বশেষ কাগজে কলমে সহ-সভাপতির তকমাও পান তিনি। যদিও অনেকটাই নখদন্তহীন।

এ হেন মুকুল রায় আজ তৃণমূল ছেড়ে দিলে দলে বিরাট কোনও ভাঙন ধরবে কেন? রাজনীতি বলে, দল ভেঙে দল গড়তে পারেন তাঁরাই যাঁদের জনসমর্থনের ভিত পোক্ত। যেমন পেরেছিলেন মমতা। তিনি কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে আসার আগেই জনসমর্থনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। শুধু ভোটে জেতা নয়, তৎকালীন সর্বভারতীয় কংগ্রেস নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে ইনডোর সম্মেলনের পাল্টা ‘আউটডোর’ সম্মেলন করে তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন, এ রাজ্যে কংগ্রেসের মূল স্রোত কোন দিকে বইছে। কালক্রমে সেখান থেকেই তৃণমূল কংগ্রেসের উৎপত্তি।

বিপরীত দৃষ্টান্ত প্রণব মুখোপাধ্যায়। ইন্দিরা গাঁধীর ঘনিষ্ঠতম ব্যক্তি এবং কংগ্রেসের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা প্রণববাবু কংগ্রেস ছেড়ে নিজে দল গড়তে গিয়ে কীভাবে নাস্তানাবুদ হয়েছিলেন, রাজনীতির ইতিহাসই তার সাক্ষী। কারণ একই। প্রণববাবু কুশলী চাণক্য হলেও জনসমর্থনের নিরিখে কোনও দিনই খুব এগিয়ে ছিলেন না। রাজনৈতিক জীবনের শেষপর্বে দুবার লোকসভা নির্বাচনে জেতা ছাড়া কোনও দিন সরাসরি ভোটে জিতে আসেননি। বরাবর জিতেছেন রাজ্যসভায়।

মুকুল ২০০১ সালে এক বারই তৃণমূলের টিকিটে বিধানসভা ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। হেরে যান। ‘তৃণমূলের চাণক্য’ ঘটনাচক্রে নিজের নির্বাচন বৈতরণী পেরোতে পারেননি। তার পর রাজ্যসভায় এবং মমতার ‘প্রসাদে’ কেন্দ্রে মন্ত্রীও।

আসলে স্ট্র্যাটেজি তৈরি করা আর মাঠে নেমে গোল করার মধ্যে বিস্তর ফারাক। জেলা কমিটির লোক বাছাই করতে জানলেই সেই জেলা তাঁর দখলে চলে এল, এমন নয়। যদি তা-ই হত, তা হলে গত কয়েক দিন নিজাম প্যালেসে মুকুল রায়ের দরবারে তিলধারণের স্থান থাকত না। তিনি তৃণমূল ছেড়ে দিচ্ছেন, সেই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে নেতানেত্রীরা তাঁকে ছেঁকে ধরতেন। তা হয়নি। আসলে হেড অফিসের বড়বাবু যত যোগ্যই হন, তাঁর বৃত্ত ওইটুকুই! ভোট টানার মুখ হয়ে ওঠা অন্য রসায়ন। আজকের পশ্চিমবঙ্গে মমতার নামে সংগঠন গড়ে তুলতে পারা যত সহজ, দল ছেড়ে এসে নিজের জোরে দল গড়া তত অনায়াসসাধ্য নয়। ভোট-নির্ভর রাজনীতিতে এটা নির্মম সত্য।

তবে কি মুকুল বিজেপিতে যোগ দেবেন? সংশয় সেখানেও। গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে নারদ কেলেঙ্কারি সামনে আসে। বিজেপির প্রচারের অন্যতম হাতিয়ার সেই কেলেঙ্কারি তৃণমূলের ভোট-ভবিষ্যতে খুব একটা ছায়া ফেলতে পারেনি। কিন্তু বিজেপি-র হোমরাচোমরা নেতারা স্লোগান তুলেছিলেন, ‘ভাগ মমতা ভাগ, ভাগ মুকুল ভাগ...’।

সারদা-তদন্তের চার্জশিটে মুকুলের নাম নেই। নারদ-কাণ্ডে নাম জড়ানোর পরে অন্য কয়েক জন নেতা মন্ত্রীর মতো মুকুলও তদন্তের আতসকাচে। যা এখনও শেষ হয়নি। এই অবস্থায় বিজেপি তাঁকে দলে নেবে তো? আর যদি সমাপতনে মুকুল বিজেপি-তে যাওয়ার পাশাপাশি নারদ মামলা থেকেও ‘মুক্ত’ হন, বিজেপি তখন কী জবাব দেবে? এটা তো এক অর্থে তৃণমূলের হাতে তুরুপের তাস তুলে দেওয়া! বিজেপি এতটা অবিবেচক হবে কি?

সব প্রশ্নের জবাব এখন ভবিষ্যতের গর্ভে। তবে একটা কথা বলা যায়। নিজে দল গড়ুন বা অন্য দলে যোগ দিন, তৃণমূলের গায়ে কাদা ছেটানোর কাজে মুকুল নিয়ন্ত্রণহীন মিসাইল হতে পারেন। কেউ হয়তো তাঁকে সে কাজে ব্যবহারও করবে। সে ক্ষেত্রে ‘ন্যুইসন্স ভ্যালু’ই হতে পারে তাঁর একমাত্র মূল্য!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন