কেমন করে লেখা হবে ইতিহাস

ভারতের পড়শি দেশের প্রসঙ্গ টেনে সে কথা শুরু করলে অভ্যস্ত কাজিয়ার দিকে বাঁক নিতে পারে আলোচনা। একটু কম-চেনা দেশ থেকে শুরু করাই ভাল। যেমন, জাপানের কথাই ধরা যাক। বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানিদের খুব অনুশোচনা হয়েছিল।

Advertisement

প্রবাল দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০১৯ ০০:০১
Share:

যুদ্ধের উৎপত্তি মানুষের মনে, অতএব মানুষের মনেই শান্তির রক্ষাকবচ প্রস্তুত করার কাজে নামতে হবে।’’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠিত ইউনেস্কোর সংবিধানের প্রাককথনের এই হল প্রথম বাক্য। দু’টি প্রতিবেশী, প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ কি সত্যিই ধৈর্য ধরে সেই ‘রক্ষাকবচ’ তৈরির কাজটা করতে পারে?

Advertisement

ভারতের পড়শি দেশের প্রসঙ্গ টেনে সে কথা শুরু করলে অভ্যস্ত কাজিয়ার দিকে বাঁক নিতে পারে আলোচনা। একটু কম-চেনা দেশ থেকে শুরু করাই ভাল। যেমন, জাপানের কথাই ধরা যাক। বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানিদের খুব অনুশোচনা হয়েছিল। তারা সংবিধানে লিখল, শান্তির লড়াইয়ে অগ্রণী হবে জাপান। বাহিনী ছোট করে, প্রতিরক্ষার খাতিরে রাখল খুব সামান্য সেনা। স্কুলে ইতিহাসের এমন পাঠ্যবই চালু করল, যেখানে বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে জাপানি আগ্রাসনের সমস্ত বৃত্তান্ত খোলাখুলি লেখা হয়েছে। দেশের শিশুদের তারা শেখাতে চাইল, দেশ এ পাপে আর কখনও লিপ্ত হবে না।

উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু আস্ত একটা দেশ কি চির কাল অনুশোচনায় আটকে থাকতে পারে? বিশেষত প্রতিবেশী চিন যদি রণসজ্জা করতে থাকে অসঙ্কোচে। ১৯৮২ সালে জাপানে গিয়েছিলাম একটা সম্মেলনে যোগ দিতে। সেখানে তখন তুমুল তর্জা চলছে ইতিহাসের নতুন পাঠ্যপুস্তক নিয়ে। সেই বইয়ের বক্তব্য হল, প্রতিবেশীদের সঙ্গে জাপান মোটের উপর শান্তশিষ্ট আচরণই করে এসেছে। আগের বইয়ে যেখানে ছিল ‘‘জাপান সামরিক অভিযান চালিয়ে ১৯১০ সালে কোরিয়া দখল করল’’, সেখানে নতুন পাঠ্যবই বলছে ‘‘১৯১০ সালে জাপানি সেনাবাহিনী কোরিয়ায় গেল।’’ কেন গেল, সে আর বলা হল না। চিনের প্রতি জাপানের নৃশংস আচরণের ইতিবৃত্তও চাপা দেওয়া হয়েছে।

Advertisement

বিচলিত হয়ে হংকং থেকে স্কুলছাত্ররা বুকের রক্ত দিয়ে চিঠি লিখল জাপানের শিক্ষামন্ত্রীকে: পুরনো বই ফিরিয়ে আনুন, নইলে ক্ষমা করব না। চিন আর দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার সতর্ক করল, নতুন বই বাতিল না করলে জাপানের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করে দেবে তারা। জাপানেরও সাংবাদিক মহলে, নাগরিক সমাজে, ছাত্র-শিক্ষকদের আলোচনায় ঝড় উঠেছে। সকলের চাপের মুখে জাপানের সরকার পিছু হটল ঠিকই। কিন্তু ওই তিনটি দেশের জটিল সম্পর্কের ইতিহাস কী ভাবে শেখানো হবে স্কুলে— সে প্রশ্নের উত্তর তো আর চাপ দিয়ে আদায় করা যায় না!

উত্তর মিলল কোরিয়া, চিন আর জাপানের বিয়াল্লিশ জন ইতিহাসবিদের এক অভিনব উদ্যোগে। তাঁদের বহু বছরের সম্মিলিত চেষ্টায় একটি পাঠ্যবই প্রকাশিত হল ২০০৫ সালে। তাতে ওই অঞ্চলের আধুনিক ইতিহাস এমন ভাবে লেখা হয়েছে, যার ভিত্তিতে তিন দেশেই (যে যার ভাষায়) স্কুলের উঁচু ক্লাসে ইতিহাসের পঠনপাঠন সম্ভব হয়। ‘যে ইতিহাস ভবিষ্যতের দরজা খুলে দেবে’ শীর্ষক ওই পাঠ্যবই অল্প কিছু সাহসী বিদ্যালয় নাকি পরীক্ষামূলক ভাবে ব্যবহার করছে। রাতারাতি সবাই এ জিনিস মানবে নাকি? তবে এমন একটা বই লেখার কাজে তিনটে দেশের এত জন ইতিহাসবিদের মতৈক্য অর্জন করতে পারাও কম কথা নয়। আমাদের তল্লাটে কোনও উদ্যোগ এতটা পূর্ণাঙ্গতা পায়নি আজ অবধি।

তবে সম্ভবত এ ব্যাপারে সবচেয়ে এগিয়েছেন শিক্ষাতাত্ত্বিক কৃষ্ণ কুমার। প্রেজুডিস অ্যান্ড প্রাইড: স্কুল হিস্ট্রিজ় অব দ্য ফ্রিডম স্ট্রাগল ইন ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান (পেঙ্গুইন, ২০০১) বইয়ে তিনি ভারতে আর পাকিস্তানে প্রচলিত কিছু ইতিহাসের পাঠ্যবই পর্যালোচনা করে দেখাতে পেরেছেন যে, দু’দেশেই রচয়িতারা গত দু’শো বছরের একই দলিলপত্র ঘেঁটেছেন। এবং সেই মালমশলার ভিত্তিতে, একটাও মিথ্যে কথা না বলে, দু’রকম কাহিনি লিখেছেন।

পাকিস্তানি শিশুরা শেখে, ১৮৫৭ সালে মুসলিম শাসকদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে ইংরেজরা নিজেদের সুবিধার্থে হিন্দুদের উচ্চবর্গকে প্রশ্রয় দেয়। মুসলিমরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ক্রমশ দেশের এমন খণ্ডিত, হতশ্রী দশা হয় যে একটা আস্ত ঐক্যবদ্ধ দেশের স্বাধীনতা লাভের প্রশ্নই উঠতে পারত না। ভাগ্যক্রমে জিন্না সুষ্ঠু ভাবে জমি ভাগ করে নিয়ে পাকিস্তানের উন্মেষের বন্দোবস্ত করে দেন। আর ভারতীয় শিশুরা শেখে, নবজাগরণের পর থেকে মহান নেতাদের চেষ্টায় স্বাধীনতা সংগ্রাম চলছিল ভালই। কিন্তু কিছু ভেদবুদ্ধিগ্রস্ত নেতার পাল্লায় পড়ে অনেক মুসলিম ভুল পথে চালিত হল। তাই দেশভাগ মেনে না নিয়ে উপায় ছিল না। নেই মামার চেয়ে খণ্ডিত মামা ভাল।

বই না-হয় দু’ভাবে লেখা হয়েছে। ছাত্ররা তো ইস্কুলের বইয়ের থেকেই সবটা শেখে না। কৃষ্ণ কুমার ভারতের আর পাকিস্তানের কিছু ইস্কুলে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে ছাত্রদের দিয়ে দেশভাগের বিষয়ে প্রবন্ধ লেখাতে পেরেছিলেন। সেই সব লেখায় যে মতামত ফুটে উঠেছে সেগুলো থেকে কিছু কিছু উদ্ধৃতি দিয়ে কৃষ্ণ কুমার ভেবে দেখার চেষ্টা করেছেন, এর পর কী করা যায়। প্রশ্ন তুলেছিলেন, কোন পথে এগোলে এমন একটা ছবি আঁকা যাবে, যেটাকে দু’দেশের শিক্ষাব্যবস্থা তথা রাষ্ট্রব্যবস্থা এই উপমহাদেশের ‘আসল ইতিহাস’ বলে চিনতে পারবে? সীমান্তের দু’দিকে দুই বিপরীত গল্পে আটকে থাকবে না?

সেটা ছিল ২০০১ সাল। ‘লাহৌর প্রক্রিয়া’ বানচাল হয়ে গিয়েছিল কার্গিলে। সংঘাতের কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছিল। কিন্তু কৃষ্ণ কুমার ভুলে যাননি, মানুষের মন নেতার মুখাপেক্ষী নয়। শিক্ষকরাই ছাত্রদের সুস্থ মনের কারিগর, তাঁরাই শান্তির রক্ষাকবচ তৈরি করেন। বিশেষ করে যে শিক্ষকেরা পাঠ্যপুস্তক রচনার দায়িত্ব নেন, তাঁদের কাছে আমাদের অনেক আশা। কৃষ্ণ কুমার সেই আশাকে পরিস্ফুট করেন, নিয়ে যেতে চান সেই জায়গায় যেখানে স্বপ্ন দেখা চলে।

সব স্বপ্নই কি অ-বাস্তব? আশির দশকের গোড়ায় জাপানে পুস্তককাণ্ডের সময়ে যে ঝগড়াঝাঁটি হয়েছিল, তা থেকে বেরোতে নিশ্চয়ই সময় লেগেছিল। মেজাজ ঠান্ডা করে তবেই না তিন দেশের এত জন শিক্ষক একত্রে একটা পরিকল্পনা করলেন। বছরের পর বছর খসড়ার পর খসড়া লিখে, অবশেষে অল্প কিছু স্কুলের শিক্ষক, যাঁরা পরীক্ষানিরীক্ষায় উৎসাহী, তাঁদের হাতে দিতে পারলেন ওঁদের বই।

যুদ্ধোত্তর জাপান সেই যে প্রতিজ্ঞা করেছিল, শান্তির ধ্বজাধারী হয়ে একাই বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেবে, তা থেকে কত দূরে তিন দেশের ওই বিয়াল্লিশ জন ইতিহাসবিদ। ‘শান্তি’ বলে কোনও একটা স্বপ্ন আছে, এমন তো নয়। নানা রকম স্বপ্ন দেখবার দরকার আছে। কোন জমিতে কোন প্রয়াস শিকড় গাড়বে, আগাম বলা যায় না। তাই নানা রকম চারাগাছ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করা এত জরুরি। ‘যুদ্ধ নয় শান্তি চাই’ বললেই হয় না। শান্তিরক্ষার কাজ মানে এক বিচিত্র বর্ণালির বিচ্ছুরণ। তার সঙ্গে আলাপ করতে বড় দেরি হয়ে যাচ্ছে যে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement