আদিবাসী পড়ুয়ার পাশ-ফেল

আশঙ্কা হয়, তাদের উন্নয়নের যে ধারা এখন দেখা যাচ্ছে, তা ব্যাহত হবে। সর্বশিক্ষা অভিযান প্রকল্পে বিদ্যালয়ের পরিকাঠামো উন্নয়ন, মিড-ডে মিল, বিনামূল্যে পুস্তক, পোশাক, সাইকেল ইত্যাদি আদিবাসী ছেলেমেয়েদের স্কুলমুখী করেছে।

Advertisement

বড় বাস্কে

শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share:

সম্প্রতি রাজ্য সরকার পাশ-ফেল ফিরিয়ে এনেছে। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে ফেল করলে পড়ুয়ারা দ্বিতীয় বার পরীক্ষায় বসার সুযোগ পাবে। তার পরেও যদি কিছু পড়ুয়া পাশ না করতে পারে, তা হলে আদিবাসী পড়ুয়াদের উপর তার কী ফল হবে?

Advertisement

আশঙ্কা হয়, তাদের উন্নয়নের যে ধারা এখন দেখা যাচ্ছে, তা ব্যাহত হবে। সর্বশিক্ষা অভিযান প্রকল্পে বিদ্যালয়ের পরিকাঠামো উন্নয়ন, মিড-ডে মিল, বিনামূল্যে পুস্তক, পোশাক, সাইকেল ইত্যাদি আদিবাসী ছেলেমেয়েদের স্কুলমুখী করেছে। ২০০৯ সালের শিক্ষার অধিকার আইন পরীক্ষায় আটকে না-রাখার নীতি এনে শিক্ষায় সামাজিক প্রতিবন্ধকতার স্বীকৃতি দিয়েছে। আদিবাসী পড়ুয়াদের লেখাপড়ায় আগ্রহ বেড়েছে।

পাশ-ফেল ফিরে এলে তা কি থাকবে? এর উত্তর স্কুলকেও খুঁজতে হবে। যে সাঁওতাল ছেলে গ্রামে খেলাধুলোয় পটু, মাদল-বাঁশি বাজাতে পারে, বিভিন্ন পশুপাখি, মাছ ধরার ফাঁদ তৈরি করতে পারে, কিংবা যে মেয়ে বাড়িতে ঝাঁটা-তালাই বুনতে পারে, মাটির দেওয়ালে চিত্র আঁকতে পারে এবং পাতা-ফুল দিয়ে নিজেকে সাজিয়ে নাচগান করতে পারে, এমন সৃষ্টিশীল প্রাণবন্ত ছেলেমেয়েরা বিদ্যালয়ে এসে কেন শ্রেণিকক্ষের শেষ বেঞ্চিতে বসে গুটিয়ে থাকে? ব্যক্তিগত জীবনে এত কিছু শেখা ও জানার পরেও পরীক্ষার ফল হাতে পাওয়ার পর কেন তাদের মনে হয় যে, তাদের সমস্ত শিক্ষা মূল্যহীন, তারা নির্বোধ?

Advertisement

এর উত্তর খুঁজতে হলে পড়ুয়ার সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সঙ্গে বিদ্যালয় শিক্ষার সংঘাতের স্থানগুলি চিহ্নিত করা প্রয়োজন। যেমন, পরীক্ষায় পা‌শ করার জন্য ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ এবং অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতার মনোভাব প্রয়োজন হয়। কিন্তু কোঁড়া, ওঁরাও, মুন্ডা, মাহালে, সাঁওতাল আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের সামূহিক জীবনযাত্রায় এমন স্বাতন্ত্র্যের বোধ কই? তাদের লোকনৃত্য, মাঠে-জঙ্গলে এক সঙ্গে কাজ, বা শিকারে যাওয়া, সব কাজের মধ্যে প্রতিফলিত সর্বসমতাবাদ। এই মতাদর্শই তাকে শক্তিশালী করে। স্কুলে পড়তে গিয়ে তার এই বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সংঘাত হয় ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষার।

বিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রিত সংস্কৃতির সঙ্গে দ্বন্দ্ব তৈরি হয় সাঁওতাল ছেলেমেয়েদের স্বাধীনচেতা মনের। তাদের গ্রামে বছরভর পরব চলে। নাচগান, খোলামেলা আনন্দময় জীবনযাত্রার টান ইস্কুলের পড়ায় ব্যাঘাত ঘটায়। জাগতিক বিত্তলাভের জন্য উচ্চাকাঙ্ক্ষার অভাব, অল্পেই খুশি থাকার বৈশিষ্ট্যও তাদের শিক্ষাব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তিতে বাধার সৃষ্টি করে। সমস্যা পড়া বুঝতে। বোঝাতেও। ভাষা ও সংস্কৃতির নিরিখে যারা সংখ্যালঘু, সেই পড়ুয়াদের সমস্যা সমাধানের কোনও বিশেষ শিক্ষণপদ্ধতি নেই। ফলে অপরিচিত ভাষা, পাঠ্যক্রম ও শিক্ষণপ্রণালীর মুখোমুখি বসে আদিবাসী পড়ুয়ারা অনুমানের ক্ষমতার উপর ভরসা করে পড়াশোনা করে। সে ভাবেই তাকে সকলের সঙ্গে একই পরীক্ষার প্রতিযোগিতায় বসতে হয়। মূল্যায়নের সময়ে আদিবাসী পড়ুয়ার এই বিশেষ সংঘাতের স্থানগুলি গ্রাহ্যের মধ্যে না রাখলে শিক্ষার অধিকারের মৌলিক উদ্দেশ্যের সঙ্গেই আপস করা হয় না কি? শিক্ষার অধিকার আইনে পুঁথিগত শিক্ষার মূল্যায়নের সঙ্গে এইগুলি বিবেচনায় রাখা হয়েছিল। এর ফলে পড়ুয়ারা অনেকটা চাপমুক্ত হয়ে শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পেরেছে। পরীক্ষায় এক জন সচ্ছল বর্ণহিন্দু পড়ুয়া পাশ করছে, তার সঙ্গে ‘আমিও পাশ করছি’ এমন আত্মবিশ্বাস তৈরি করছে। আমি পারি, আমরাও পারি— এই বিশ্বাস জন্মােত শুরু করেছে।

তার সুফলও আমরা পেতে শুরু করেছি। ২০০৮ সালে কুমকুম কোঁড়া যখন প্রথম মেয়ে হিসেবে তাদের গ্রাম রিনডাঙা থেকে মাধ্যমিক পাশ করেছিল, তখন যে মেয়েরা ইস্কুলে ভর্তি হত, তারা বেশির ভাগ অষ্টম শ্রেণি পৌঁছনোর আগেই ফেল করে গতানুগতিক জীবনে ফিরে যেত। মা-বাবারাও মনে করতেন, ইস্কুলে যাওয়া মানে ফেল করতে যাওয়া। তাই সন্তানদের সংসার ও মাঠের কাজে পাঠানো শ্রেয় মনে করতেন। সেই সব গ্রামে এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে। মেয়েরা হাই স্কুলে যাচ্ছে, বাবা-মা ছেলেমেয়েদের জন্য সময় ও অর্থ ব্যয় করার উপযোগিতা বুঝতে পারছেন। রিনডাঙা গ্রামে ছত্রিশ জন ছেলেমেয়ে মাধ্যমিক, বিএ, এমএ পাশ করেছে, অনেকে চাকরি করছে। মেয়েরা নিজেদের ভাষায় শিশুদের জন্য গল্পের বই লিখছে, গানের সিডি প্রকাশ করছে। পাশের সাঁওতাল গ্রাম আসাদুল্লাপুরে ২০১০ অবধি কোনও মাধ্যমিক পাশ মেয়ে ছিল না। সেখানে এখন ষোলো জন ছেলেমেয়ে মাধ্যমিক পাশ করে উচ্চতর পড়াশোনা করছে।

ভবিষ্যতে কে কোন পেশায় প্রতিষ্ঠিত হবে, কেউ বলতে পারে না। তবে নীচের ক্লাসে সাফল্যের স্বাদ পেলে এগিয়ে যাওয়ার আগ্রহ বাড়ে। শিক্ষায় ভয়ের জুজু দেখিয়ে ছাত্রদের কাছ থেকে যতটা ফল পাওয়া যায়, তার চাইতে তাকে অনুপ্রাণিত করলে সাফল্য মেলে বেশি, এবং তা দীর্ঘস্থায়ী হয়। ইদানীং গ্রামে বাবা-মায়েদের প্রায়ই বলতে শোনা যায়, ‘‘আমাদের সময় ফেল না-করার ব্যবস্থা থাকলে আমরা কবে বিএ পাশ করে চাকরি করতাম।’’ সেই আক্ষেপ আবার ফিরে আসবে না তো?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন