ওঁরা সতর্ক করেছিলেন

সংবিধান জিনিসটা তো ঠিক আরাম করে পড়ার নয়, বদলে নেহরুর এই চিঠিগুলি নাড়াচাড়া করলেও একটা সহজ সংবিধানের সন্ধান মেলে।

Advertisement

সেমন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০১৭ ০৬:০০
Share:

দায়িত্ব: দেশ জুড়ে স্বাধীনতার আন্দোলন চলছে, অক্লান্ত নিষ্ঠায় জনসংযোগ করে চলেছেন জওহরলাল নেহরু। শিমলা। ছবি: গেটি ইমেজেস

পনেরো অগস্ট মধ্যরাতে ‘নিয়তির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা’র শপথটির পরই নতুন দেশের অজস্র কাজে ডুবে গেলেন প্রথম প্রধানমন্ত্রী। তারই মধ্যে মনে হল: নতুন দেশটা ঠিক কী রকম হতে চায়, সেটা সকলকে বোঝানো জরুরি। দায়িত্বটা তাঁকেই নিতে হবে। আচ্ছা, পনেরো দিন অন্তর প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রীদের চিঠি লিখলে কেমন হয়? প্রশাসনিক আদানপ্রদান সূত্রে দেশের কথা আলোচনা করা যায় তা হলে! ঠিক দু’মাস পর, ১৯৪৭-এর ১৫ অক্টোবর থেকে শুরু হল চিঠি লেখার পালা। চিঠিগুলোর প্রেক্ষিত আলাদা হলেও অদ্ভুত একটা সংযোগ ছিল প্রতিটির মধ্যে। সংবিধান তখনও লেখা হয়নি। এই চিঠিগুলোই যেন দেশ শাসনের নির্দেশিকা।

Advertisement

সংবিধান জিনিসটা তো ঠিক আরাম করে পড়ার নয়, বদলে নেহরুর এই চিঠিগুলি নাড়াচাড়া করলেও একটা সহজ সংবিধানের সন্ধান মেলে। নতুন দেশের কোন কোন দিকে খেয়াল রাখতে হবে, কোথায় ভুল হয়ে গেলে ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে তফাত থাকবে না, এ সব বলছেন তিনি। প্রথম দু’মাসেই অনেকে মনে করছেন, কেন্দ্রীয় সরকার সংখ্যালঘুদের প্রতি একটু বেশি দুর্বল, তোষণের মানসিকতায় আবদ্ধ। না— নেহরুর স্পষ্ট কথা— তোষণ উদ্দেশ্য নয়, ভালও নয়। কিন্তু এও ঠিক যে দেশের সংখ্যালঘুদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতেই হবে! দেশভাগের পর এ দেশে এত মুসলিম থেকে গিয়েছেন, ‘এই মানুষগুলির প্রতি আমাদের একটা দায়িত্ব আছে’, ‘যাতে এঁরা এ দেশে নিরাপদ বোধ করেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যে সব সাধারণ অধিকার, তার থেকে কোনও মতে বঞ্চিত না হন।’

সংখ্যালঘু তোষণ বলতে নেহরুর ভারতের নামে যে অভিযোগ, তার ভিতরের কথা এটাই। এ দেশে যাঁরা সংখ্যায় কম, তাঁদের প্রতি মনোযোগী থাকা, প্রান্তিকতায় ঠেলে দিয়ে তাঁদের ওপর অত্যাচার না করা। ‘সংখ্যা’ খুব গোলমেলে জিনিস, গণতন্ত্রের নামে সংখ্যাগত ‘মেজরিটি’ বা সংখ্যাগুরুবাদ না চালানো। প্রথম প্রধানমন্ত্রীর প্রথম বার্তা।

Advertisement

কথাটা কত গুরুতর, সেটা একটু উল্টো দিক থেকে দেখা যাক। হিন্দু-মুসলমান প্রশ্নটা বড্ড ঝামেলার, আপাতত ওটা ছেড়ে দিয়ে একটা অন্য সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু সমস্যা ধরা যাক। ওই ১৫ অগস্টেই বিষম উদ্বিগ্ন ছিলেন দক্ষিণ ভারতের সমাজদার্শনিক, পেরিয়ার ই ভি রামস্বামী। বিপ্লবী ব্রাহ্মণ্যবাদবিরোধী নেতাটির মনে হয়েছিল, এই বার উত্তর ভারতীয় সংখ্যাগুরুবাদের কোপ নেমে আসতে চলেছে দক্ষিণ ভারতের উপর। হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিটাই তো বুঝিয়ে দেয় এই সংকীর্ণ অসহিষ্ণুতা। এটা তো কেবল উত্তর-দক্ষিণ সমস্যা নয়, এটা সংখ্যার নামে জবরদস্তি। মোক্ষম পাল্টা যুক্তি তাঁর, গণতন্ত্রের মানে যদি হয় বেশি সংখ্যক যা-কিছু, সেটা বাকিদের উপর চাপিয়ে দেওয়া, তবে ময়ূরের বদলে কাক হোক জাতীয় পাখি, আর বাঘের বদলে ইঁদুর হোক জাতীয় পশু!

আসলে, সংখ্যা পেরিয়ে এর মধ্যে ক্ষমতার খেলা দেখেছিলেন পেরিয়ার। ব্রাহ্মণ্যবাদের ক্ষমতা। সংখ্যা বলতে সুবিশাল দরিদ্র জনসমাজ নিশ্চয়ই তার মতামত প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে না, বরং তাদের সংখ্যার আশ্রয় নিয়ে উপরে-চেপে-বসে-থাকা নেতারা যথেচ্ছাচার করবেন, এটাই হবে নতুন দেশ। এই পথেই নতুন দেশের সামনে ভয়ংকর দুর্দিন।

স্বাধীন দেশটি যে রামা কৈবর্ত রহিম শেখদের নয়, কেবল সম্পন্ন ভারতীয়ের সম্পত্তি, এটা তখন তীব্রস্বরে বলছিলেন আরও অনেকে, যাঁদের স্লোগান ‘ইয়ে আজাদি ঝুটি হৈ’। কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক বি টি রনদিভে-র এই ‘লাইন’ সাধারণত ভারতীয় ইতিহাসের একটি কালো মূহূর্ত হিসেবে দেখা হয়। এই ‘লাইন’-এর দাপটে পি সি জোশীর মতো নেতা দল থেকে বহিষ্কৃত হন, কেননা জোশীর মতে, বিপ্লবাত্মক সংগ্রাম তৈরির জন্যও স্বাধীনতা অর্জন জরুরি। কিন্তু তর্ক সরিয়ে একটা কথা আজ স্বীকার করতেই হবে: স্বাধীনতা-পূর্ব সময় থেকে নানা কিষাণ আন্দোলন, জনজাতি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন যে সমাজমনস্ক নেতারা, তাঁদেরও কিন্তু মনে হয়েছিল, শুধু জাতীয়তা আর স্বাধীনতা দিয়ে দরিদ্র মূর্খ চণ্ডাল ভারতবাসীর উপকার হবে না। মৌলিক আদর্শগুলির দিকে এগোনো যাচ্ছে কি না, সেটাই আসল কথা।

সব নাগরিকের মধ্যে সমতার আদর্শের দিকে কোন পথে এগোনো যায়, বড় মতান্তর ছিল সেটা নিয়েই। নেহরুর বিশ্বাস, দেশের নতুন প্রতিষ্ঠিত পাবলিক সার্ভিস বা জন-সংশাসনের প্রতিষ্ঠানগুলি আদর্শ মেনে কাজ করলে সমস্যা মিটবে। তাই তাঁর চিঠিপত্রের দু’নম্বর সতর্কবাণী: এক মুহূর্তের জন্যও যেন নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত না হয় এই সব প্রতিষ্ঠান, নয়তো পাকিস্তানের দশা হবে— যেখানে প্রতিষ্ঠানগুলি নিরপেক্ষ নয় বলে সমাজটাও ‘দ্রুত হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে।’

সদ্য-স্বাধীন দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে অন্য এক নেতাও তখন একই আশঙ্কায় ডুবে। একই সাবধানবাণী তাঁর মুখে। সংবিধান লেখা হচ্ছে, কিন্তু সেই সংবিধান কি আদৌ এ দেশে ভিত গড়তে পারবে? গণপরিষদের প্রতিটি বক্তৃতাতেই যা বলছিলেন তিনি, ১৯৫০-এর ২৬ জানুয়ারি সংবিধান গ্রহণের আগে শেষ বক্তৃতাতে ভীমরাও অম্বেডকরের সেই জমা উদ্বেগ বেরিয়ে এল খানখান তীক্ষ্ণতায়। ‘স্বাধীনতা পেয়েছি, খুব ভাল কথা, কিন্তু এই স্বাধীনতা কি রাখতে পারব আমরা?’ শুধু তো বাইরের শত্রু নয়, ভেতরের শত্রুর থেকেও তো দেশটাকে বাঁচাতে হবে! জাত-ধর্মের বিভেদের মধ্যে ডুবে না গিয়ে একটা ঐক্য ধরে রাখতে হবে! অম্বেডকর মোটেই আশাবাদী হতে পারছিলেন না। ইতিহাস পড়েশুনে তীক্ষ্ণধী মানুষটির মনে হয়েছিল, প্রথম সমস্যা, ভারতের মানুষ কোনও কালে সাম্যে বিশ্বাস করে না। সবাই সমান হোক, এটা ভাবাই তাদের পক্ষে অসম্ভব। সংবিধান দিয়ে হয়তো এক ব্যক্তি এক ভোটের রাজনীতির সমতা তৈরি করা যায়, কিন্তু সামাজিক সমতা? অর্থনৈতিক সমতা?

দ্বিতীয়ত, অম্বেডকরের মতে, আর একটি বস্তুতে ভারতীয়দের বিশ্বাস নেই— ভ্রাতৃত্ব। সমান হোক না হোক, ‘ওরা-আমরা সবাই ভাই’, এটা চেতনাগত ভাবেই ভারতীয়দের আয়ত্তের বাইরে। তা হলে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা যাবে কী করে? ‘স্বাধীনতার পর চার দিকে সবাই চায় ‘দ্য পিপল অব ইন্ডিয়া’ না বলে ‘দি ইন্ডিয়ান নেশন’ বলা হোক’, তাতেই নাকি ঐক্যের ভাবটা ভালমতো ফোটে! অম্বেডকরের তীক্ষ্ণ উত্তর: ‘আমার তো মনে হয়, নিজেদের ‘দ্য নেশন’ বা ‘একটি জাতি’ বলে আমরা কেবল ছেলে ভোলাচ্ছি!’ যে দেশের লোক এত হাজার বছর ধরে নিজেদের মধ্যে বিচ্ছিন্ন, তারা হঠাৎ আজ এক জাতি হতে যাবেই বা কেন? ওই সব না ভেবে বরং সকলের মধ্যে একটা ফ্রেটার্নিটি বা ‘ভ্রাতৃত্ব’ তৈরি করা যায় কি না, সেটাই দেখো। উপায় একটাই: সংবিধানের নীতিগুলো প্রাণপণ আঁকড়ে থাকা। মুহূর্তের জন্যও বিচ্যুতির প্রলোভনে পা না দেওয়া। ছোট বড় সব জায়গায় সমানাধিকারের নীতি মেনে চলা। ‘দেয়ার ইজ (আ) গ্রেট ডেঞ্জার অব থিংস গোয়িং রং,’ বললেন তিনি। নেহরুও ঠিক যে কথা বলছিলেন।

দেশের মানুষকে, বিশেষত সংখ্যালঘুকে এক মুহূর্তও অ-নিরাপদ বোধ করতে দেওয়া যাবে না, নেহরুর এই সতর্কবাণী যখন চিঠিতে লেখা হচ্ছিল, আর এক নেতার নীরবতার ভর্ৎসনা সদ্য-স্বাধীন দেশের বিবেককে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল সে দিন। ১৫ অগস্ট থেকে পরের ৩০ জানুয়ারি: একটি দিনের জন্যও গভীর বিষাদ থেকে বেরোননি মহাত্মা গাঁধী। এক জন ভারতীয় মুসলিমও যদি অ-নিরাপদ বোধ করে, তবে— না, এ দেশ তাঁর দেশ নয়। কত কথা এত দিন বলে এসেছেন সাম্য ভ্রাতৃত্ব সহাবস্থান নিয়ে। স্বাধীনতা তাঁর সব কথা থামিয়ে দিয়েছিল।

সংখ্যালঘু হোক, প্রান্তিক হোক, শ্রমজীবী মানুষ হোক, তাদের নিয়ে সে কালের এই সব নেতার নীরব বা সরব উদ্বেগ বা আশঙ্কার মধ্যে যে আসলে ‘তোষণ’ ছাড়া কিছুই নেই, এমন কথা ভাবা ও বলার লোক সে দিনও কম ছিল না। নাথুরাম গডসে তো একক ব্যক্তি নন, একটা ‘অন্য’ অসহিষ্ণু সমাজের মুখপাত্র! ন্যায়ভিত্তিক সমাজের আদর্শ, বহু-ধর্মবর্ণভাষাজাতিময় দেশকে শান্ত ও স্থির রাখার আদর্শ— এই সব ‘হাবিজাবি’ নিয়ে ভাবার ক্ষমতা বা ধৈর্য বা স্থৈর্য বা ইচ্ছা কোনওটাই সেই ‘অন্য’ সমাজটার সে দিনও ছিল না, আজও নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন