মোদী যদি ট্রাম্পের সঙ্গে পরিবেশ নিয়ে কথা বলার সুযোগ পান

আলিঙ্গন না করাই ভাল

প্রধানমন্ত্রী মোদীর ওয়াশিংটন সফরের আগে এমন অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হওয়াটা একটু দুঃখের। কারণ, দুই রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে অনেক বিষয়েই বেশ মিল আছে। এ ক্ষেত্রে কূটনীতি হয়তো চাইবে, পরিবেশ চুক্তির প্রশ্নটি ট্রাম্প-মোদী আলোচনার বাইরেই থাকুক।

Advertisement

ভাস্কর চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০১৭ ১২:৪০
Share:

শিল্পী: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ডোনাল্ড ট্রাম্পের যে কথা সেই কাজ। তিনি বলেছিলেন, প্যারিসে সম্পন্ন জলবায়ু চুক্তি থেকে আমেরিকাকে সরিয়ে নেবেন, সরিয়ে নিয়েছেন। বিশ্ব উষ্ণায়ন বাড়ুক, পৃথিবী দগ্ধ হোক, তাঁর কিছু যায় আসে না। এই চুক্তির প্রবল সমালোচনা করেই তিনি ক্ষান্ত থাকেননি, তাঁর মতে, ‘এই চুক্তিটি পরিবেশ নিয়ে ততটা ভাবেনি, যতটা ভেবেছে (আমেরিকা ছাড়া) অন্যান্য দেশের অর্থনৈতিক লাভের কথা।’ তিনি আলাদা করে চিন ও ভারতকে ঠেস দিয়ে বলেছেন যে, তারা অন্য দেশের খরচে নিজের লাভ আদায় করতে চায়। ট্রাম্প আরও বলেছেন, প্যারিস চুক্তি চিনকে ‘শ’য়ে শ’য়ে নতুন কয়লা খনি তৈরি’র অনুমোদন দিয়েছে, আর ভারতকে বলেছে, তারা ‘২০২০ সালের মধ্যে কয়লা উৎপাদন দ্বিগুণ’ করতে পারবে। তাঁর মতে, ‘এই চুক্তি অনুযায়ী আমরা এ সব খনি বা কারখানা তৈরি করতে পারব না, কিন্তু ওরা পারবে।’ এখানেই শেষ নয়। প্যারিস-চুক্তিতে উন্নয়নশীল দেশগুলির সৌরবিদ্যুৎ ইত্যাদি পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগের জন্য উন্নত দেশগুলি একটি তহবিল তৈরি করেছিল। ট্রাম্প সেই তহবিল থেকে আমেরিকাকে সরিয়ে নিয়েছেন। এর ফলে ভারতের মতো দেশের সমস্যা বাড়বে।

Advertisement

প্রধানমন্ত্রী মোদীর ওয়াশিংটন সফরের আগে এমন অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হওয়াটা একটু দুঃখের। কারণ, দুই রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে অনেক বিষয়েই বেশ মিল আছে। এ ক্ষেত্রে কূটনীতি হয়তো চাইবে, পরিবেশ চুক্তির প্রশ্নটি ট্রাম্প-মোদী আলোচনার বাইরেই থাকুক। কিন্তু যদি সে প্রসঙ্গ তাঁদের আলোচনায় উঠে আসে, তবে মোদী কী কী বলতে পারেন? তাঁর সুবিধের জন্য একটি মুশকিল আসান তালিকা দেওয়া যাক।

প্রথমত, মোদীকে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পরিবেশ চুক্তিটিকে বুঝতে হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট মনে করেন, ‘এই চুক্তি চিন তার নিজের লাভের জন্য তৈরি করেছে।’ জলবায়ু পরিবর্তন ব্যাপারটা সত্য না মনগড়া, সে বিষয়ে ট্রাম্প কী বিশ্বাস করেন, সেটা অপ্রাসঙ্গিক। তাঁর কাছে এই প্রশ্নে দুটো অবস্থান সম্ভব। এক দিকে, প্যারিস চুক্তি এবং তার সঙ্গে জড়িত যত রকমের ‘মেয়েলি’ ধারণা, অন্য দিকে ‘কোল-কান্ট্রি’র (পূর্ব আমেরিকার পুরনো খনি ও শিল্পাঞ্চল, এখন যার অর্থনীতি বেহাল) মানসিকতা, যেখানে পুরুষরা ‘সত্যিকারের’ পুরুষ। সেখানকার মানুষই ট্রাম্পকে জিতিয়ে এনেছেন।

Advertisement

দ্বিতীয়ত, মোদী সম্প্রতি ইউরোপে নিজেকে পরিবেশবান্ধব সুপারহিরো রূপে পেশ করেছেন। সেই ভাবমূর্তিটি আড়াল করা প্রয়োজন। ট্রাম্পকে এ-কথাটা মনে না করিয়ে দেওয়াই শ্রেয় যে, তাঁর আমেরিকা একটি নতুন ক্লাবে যোগ দিয়েছে: প্যারিস-চুক্তি বয়কটকারীদের ক্লাব, যে ক্লাবের সদস্য দেশগুলির মধ্যে দুটির নাম সিরিয়া আর নিকারাগুয়া, আর অন্য একটি ক্লাব থেকে বেরিয়ে এসেছে: প্যারিস চুক্তি-সমর্থক ক্লাব, ভারত ও চিন যার সদস্য। এই দ্বিতীয় ক্লাবটির সদস্য দেশগুলির লক্ষ্য হল, প্যারিস চুক্তিতে তারা নিজেরা কার্বন নিঃসরণ যতটা কমানোর অঙ্গীকার করেছে, কার্যক্ষেত্রে সেই নিঃসরণ তার চেয়েও বেশি কমানো। তিন বছর ধরে চিন কয়লার ব্যবহার কমিয়ে আনছে, শ’খানেক তাপ-বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করেছে। পাশাপাশি, ভারতের প্রস্তাব, আগামী দশ বছরে তার মোট শক্তি উৎপাদনের ৫৭ শতাংশ আসবে সৌরবিদ্যুৎ আদি পুনর্নবীকরণযোগ্য উৎস থেকে।

তৃতীয়ত, মোদীর জানা উচিত, প্যারিস চুক্তি দেখালে ট্রাম্প খুশি হবেন না। তাঁর অভিযোগ, ২০৩০ সাল বা তার কাছাকাছি সময় পর্যন্ত ভারত ও চিন নিঃসরণ মাত্রা বাড়াতে পারবে, কিন্তু আমেরিকাকে নিঃসরণ মাত্রা এখনই কমাতে হবে। ট্রাম্প প্রশ্ন করতেই পারেন, এ কেমনধারা খেলা, যেখানে বিভিন্ন দেশের কাছে দাবি এতটাই আলাদা! তিনি হয়তো টুইটারে লিখবেন: পরিবেশ রক্ষার এই খেলাটি আসলে পুরোটাই কারচুপির খেলা।

চতুর্থত, ভারতের বদলে চিনের নেতা হোয়াইট হাউসে হাজির হলে তিনি কী বলতেন, সেটা মোদীর জেনে রাখা ভাল। চিন এই বলে যুক্তি সাজাত যে, আমেরিকা এক সময় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রচুর কার্বন নিঃসরণ করেছে। চিন তো উন্নতির এই পথে এসেছে অনেক পরে, সর্বোচ্চ কার্বন নিঃসরণকারী দেশের তকমাটি আমেরিকার কাছ থেকে তার হাতে এসেছে অতি সম্প্রতি। ১৮৫০ থেকে ২০১১ অবধি পৃথিবীর মোট কার্বন নিঃসরণের ২৭ শতাংশই করেছে আমেরিকা, চিনের অবদান ১১ শতাংশ। এবং, আমেরিকার মোট জনসংখ্যা যত, এখনও দেশের প্রায় তত জন মানুষকে দারিদ্র থেকে মুক্তি দিতে হবে চিনকে। যখন কোনও দরিদ্র দেশ ধনী হতে চায়, তখন উন্নতির জন্যই নিঃসরণ বাড়ে, বিশেষত, কয়লা যখন জ্বালানির সুলভ উৎস।

পঞ্চমত, মোদী ট্রাম্পকে বলতে পারেন, ভারতকে চিনের সঙ্গে এক গোত্রে ফেলা অন্যায়। পরিসংখ্যানে ভারত কার্বন নিঃসরণকারী দেশ হিসেবে আমেরিকা ও চিনের পরে তিন নম্বর স্থানে রয়েছে বটে, কিন্তু আসলে আমেরিকা ও চিনের সঙ্গে তার কোনও তুলনাই হয় না। ১৮৫০ থেকে ২০১১ সাল অবধি বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণের মাত্র ৩ শতাংশের জন্য দায়ী ভারত। এবং, মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণে আমেরিকার অবদান ভারতের ৮ গুণ। চিনের ক্ষেত্রে সেই মাত্রা ভারতের ৪ গুণ। ভারত দরিদ্র দেশ, উন্নতির দ্রুত গতি বজায় রাখতে হলে আপাতত তাকে নিঃসরণের মাত্রা বাড়াতেই হবে।

ষষ্ঠত, পরিবেশ রক্ষার যথাযথ আয়োজনের দাবি জানাতে চাইলে মোদীকে কতকগুলি ন্যায্য মাপকাঠি বেছে নিতে হবে। বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে পরিবেশ সংক্রান্ত লক্ষ্যমাত্রা বিভিন্ন হতে পারে, এ কথা ট্রাম্প যদি মেনে নেনও, তা হলে মোদীর উচিত কোনও তৃতীয় পক্ষের নিরপেক্ষ মূল্যায়নকে পুঁজি করে তাঁর সম্মুখীন হওয়া। ‘ক্লাইমেট অ্যাকশন ট্র্যাকার’ নামক আন্তর্জাতিক মূল্যায়নে, আমেরিকা, চিন ও ভারত— এই তিনটি দেশই নিজেদের নিঃসরণ মাত্রা কমানোর যে লক্ষ্য ধার্য করেছে, তা খুব ভালও নয়, খুব খারাপও নয়, পরিবেশ রক্ষার উদ্যোগে তিনটি দেশই আছে মাঝামাঝি পর্যায়ে।

ট্রাম্পকে কিছু শেখানো খুব কঠিন। ভারত যে পরিবেশ রক্ষায় নিজের প্রতিশ্রুতির চেয়েও বেশি কাজ করছে, সেটা তাঁকে বোঝাতে চাইলে মোদীকে একটু বেশিই সাহস সঞ্চয় করে যেতে হবে। প্যারিস চুক্তির পর ভারত পরিবেশ রক্ষার জন্য যা যা করেছে, সেই সব বিবেচনা করলে দেখা যাবে, সে এখন মাঝারি গোত্র পেরিয়ে পরের ধাপে উঠে গিয়েছে। ২০২২-এর মধ্যে পুনর্নবীকরণযোগ্য উৎস থেকে ১৭৫ গিগাওয়াট শক্তি উৎপাদনের পরিকল্পনা করেছে ভারত। ২০৩০-এর মধ্যে সব গাড়ি বিদ্যুৎচালিত করতে চায় সে, যদিও এটা একটু বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষার সূচক।

কিন্তু হায়! এ সব কথায় সম্ভবত ট্রাম্পের বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই। পরিবেশ সংক্রান্ত সব হিসেবই তাঁর মতে ভুয়ো খবর। হয়তো মোদীর সঙ্গে তাঁর পরিবেশ নিয়ে কোনও কথাই হবে না। করমর্দন, হাসি আর আলিঙ্গনেই সীমাবদ্ধ থাকবে এই সৌজন্য সাক্ষাৎ। নানা অভিযোগে আর তদন্তে নাজেহাল মার্কিন প্রেসিডেন্টের এখন এই তিনটি জিনিসই খুব দরকার। আলিঙ্গনটা অবশ্য বাদ দেওয়াই ভাল, কারণ ট্রাম্প জীবাণু-সংক্রমণকে খুব ভয় পান। দুই নেতার আলোচনায় হয়তো কেবল এইচওয়ান-বি ভিসা, ব্যবসাবাণিজ্য নিয়ে কথা হবে। আর হ্যাঁ, মুম্বইয়ে ট্রাম্পের যে সব সম্পত্তি আছে, সেগুলি দেখতে আসার জন্য মোদী তাঁকে আমন্ত্রণ জানাতে পারেন।

দুঃখের কথা একটাই। মোদী পরিবেশের বিষয়টি আলোচনায় তুলতে পারলে তিনি সত্যিকারের এক জন সুপারহিরোর কেতা নিয়ে দেশে ফিরতে পারতেন। পৃথিবী দগ্ধ হলে কারও ভাল হবে না, এমনকী কোল-কান্ট্রির কট্টর ট্রাম্প-পন্থীদেরও নয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টাফ্টস ইউনিভার্সিটির ফ্লেচার স্কুল-এ অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন