হারিয়াছে গণতন্ত্র

এখানেই দ্বিতীয় প্রশ্ন— যদি আদালতেই নিষ্পত্তি করিতে হয়, তবে এই নাটকটি কেন? সিবিআইও গোড়াতেই আদালতের দ্বারস্থ হইতে পারিত। রাজ্য সরকারও সুপ্রিম কোর্টকে এই জুলুমের কথা জানাইতে পারিত। প্রয়োজনে সুপ্রিম কোর্ট যে মধ্যরাত্রেও মামলা শুনিতে প্রস্তুত, কর্নাটক বিধানসভা নির্বাচনের পর তাহাও জানা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share:

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

গেম থিয়োরি বা দ্বন্দ্বতত্ত্বের তাত্ত্বিকরা বলিবেন, ইহা তো হামেশাই হইতেছে— ‘পজ়িটিভ সাম গেম’-এ দুই পক্ষেরই লাভ হয়। রবিবার হইতে কলিকাতায় যে কুনাট্য জমিয়াছিল, তাহাকে ‘পজ়িটিভ সাম গেম’ বলা চলে কি না, সেই তর্ক বকেয়া থাকুক। বরং, হিসাবশাস্ত্রের প্রশ্ন তোলা যাউক— তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি, উভয় পক্ষই যদি জয়ী হয়, তবে পরাজয় হইল কাহার? এই প্রশ্নের উত্তর গোটা ভারত জানে। হারিল গণতন্ত্র, হারিল সৌজন্যবোধ। সিবিআই নিমিত্তমাত্র— মেঘনাদরূপী বিজেপি যে খেলাটি সাজাইয়াছিল, তাহা ঔচিত্যের বহু গণ্ডি লঙ্ঘন করিল। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেই স্পষ্ট, কলিকাতার পুলিশ কমিশনারের উপর জবরদস্তি করিবার কোনও প্রয়োজন সিবিআইয়ের ছিল না। রাজ্য প্রশাসনকে অন্ধকারে রাখিয়া, ছুটির দিন রাজীব কুমারের বাড়িতে হানা দেওয়ার মধ্যে যে অসমীচীনতা আছে, তাহার বিশদ ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। অন্য দিকে, পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসন তাহার পুলিশকে যে ভাবে ব্যবহার করিল, তাহাও নিতান্ত বাড়াবাড়ি। কমিশনারকে সিবিআইয়ের হাতে তুলিয়া দিতে রাজ্য প্রশাসনের আপত্তি থাকিতে পারে, পুলিশ সিবিআইয়ের দলকে ঠেকাইতেও পারে। কিন্তু, যে ঘটনা ঘটিল এবং গোটা দুনিয়া দেখিল, তাহা পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে সুস্থ বিজ্ঞাপন নহে। জয়ের দাবি করিতে ব্যস্ত দুই পক্ষই ভাবিয়া দেখিতে পারে, যাহা একটি নিতান্তই প্রশাসনিক প্রশ্ন ছিল, তাহার ফয়সলার জন্য শেষ অবধি সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হইতে হইল, ইহা কি আইনবিভাগ, শাসনবিভাগ এবং বৃহত্তর অর্থে রাজনীতির পরাজয় নহে? তাহারাই কি স্বীকার করিতেছেন না যে কোনও একটি বিষয়কে সুষ্ঠু ভাবে সামলাইবার মতো পরিণতমনস্কতা তাহাদের নাই? বিচারবিভাগই ভরসা?

Advertisement

এখানেই দ্বিতীয় প্রশ্ন— যদি আদালতেই নিষ্পত্তি করিতে হয়, তবে এই নাটকটি কেন? সিবিআইও গোড়াতেই আদালতের দ্বারস্থ হইতে পারিত। রাজ্য সরকারও সুপ্রিম কোর্টকে এই জুলুমের কথা জানাইতে পারিত। প্রয়োজনে সুপ্রিম কোর্ট যে মধ্যরাত্রেও মামলা শুনিতে প্রস্তুত, কর্নাটক বিধানসভা নির্বাচনের পর তাহাও জানা। কোনও পক্ষই গোড়ায় আদালতের দ্বারস্থ হয় নাই, তাহার কারণটি আঁচ করা সম্ভব— কেহই সমাধান চাহে নাই, শুধু রাজনীতি চাহিয়াছে। বিজেপির বাসনা ছিল, কলিকাতার নগরপালকে গ্রেফতার করিয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিড়ম্বনায় ফেলিবে। অন্য দিকে, সিবিআইয়ের বে-এক্তিয়ার আচরণ যে সর্বভারতীয় রাজনীতির প্রশ্ন হইয়া উঠিতে পারে, এবং তাহা যে তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষেই যাইবে, এই হিসাবটি কষিতে কালীঘাটেরও দেরি হয় নাই। অতএব, বিজেপির রাজনীতির জবাব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনীতির অস্ত্রেই দিয়াছেন। এবং, মোক্ষম দিয়াছেন। কেহ প্রশ্ন করিতে পারেন, ধর্নায় বসিয়া পড়া কি মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে শোভন বা সমীচীন? উত্তরটি মুখ্যমন্ত্রী দিবেন না, তৃণমূল সভানেত্রী দিবেন। বলিবেন, রাজনৈতিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগাইবার মধ্যে বিন্দুমাত্র অন্যায় নাই। উত্তরটি ভুল নহে। বিজেপি তাঁহাকে ফুলটস বল দিয়াছে, তিনিও সপাটে ব্যাট চালাইয়াছেন। রাজনীতি জিতিয়াছে, বিলক্ষণ। হারিয়াছে প্রশাসনিকতা। হারিয়াছে গণতন্ত্রের শিষ্টতার বোধ। কিন্তু, গণতন্ত্রকে লইয়া, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে লইয়া কাহারও দুশ্চিন্তা ছিল বলিয়া সংশয় হয় না। থাকিলে, বিজেপি সিবিআইকে নিজেদের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করিবার কাজে ব্যবহার করিতেছে, এ হেন অভিযোগের অবকাশই তৈরি হইত না। অথবা, পুলিশ শাসক দলের শাখা সংগঠনে পরিণত হইয়াছে, এই কথাটিও কেহ ভাবিবার সুযোগ পাইতেন না। প্রকৃতপক্ষে হারিয়াছে এই ঔচিত্যের বোধ। খেলাটি ‘জ়িরো সাম গেম’-ই ছিল। রাজনীতিকরা জিতিয়াছেন। হারিয়াছে গণতন্ত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement