যাই-যাই করছে ইংরেজি বছর। সূর্যের চার পাশে ঘুরে আসতে পৃথিবীর সময় লাগে এক বছর। কিন্তু সে বছরটি কখন শুরু আর কবে শেষ, ভিন্ন ভিন্ন দেশের ও কালের মানুষ তার হিসেব ভিন্ন ভিন্ন ভাবে করেছেন। ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের কল্যাণে মানুষের দেশ-কাল আজ মিলেমিশে গেছে। ইংরেজি বছরটাই মোটামুটি ভাবে সারা পৃথিবীর মানুষের কাজের বছর হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলা ক্যালেন্ডার আটকে আছে আমাদের পালাপার্বণ, তিথি-সংক্রান্তির সঙ্গে। আজ ইংরেজি ক্যালেন্ডার আমাদের নাগরিক ও বিশ্বায়িত জীবনে সালতামামির সময়।
এই সময় রঙিন ম্যাগাজিনগুলো নানা ছবি-সহ সারা বছরের একটি খতিয়ান বের করবে। একটি মার্কিন পত্রিকা ঘোষণা করে দিয়েছে এ বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘মানুষ’টির নাম— কোনও ব্যক্তি-মানুষ নন, এই সম্মান পেয়েছেন মার্কিন মহিলাদের যৌন হেনস্তা-বিরোধী ‘মি টু!’ আন্দোলন। ভক্তরা মুখিয়ে ছিলেন, এই পত্রিকা তাঁদের প্রিয় নেতা নরেন্দ্র মোদীর নাম করে কি না, দেখতে। সে আর এ বছর হল না। কাগজে কাগজে সম্পাদকীয় স্তম্ভ জুড়ে আলোচনা চলবে বছরটা কেমন গেল। গণতন্ত্রের বিশ্বব্যাপী সংকট, প্রযুক্তির অত্যাশ্চর্য উন্নতি, বিভিন্ন দেশে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক নেতাদের অভ্যুদয়, জিহাদি ইসলাম, শরণার্থী-বিরোধিতা, পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ুর পরিবর্তন ইত্যাদি নানা প্রশ্নে মুখরিত হয়ে উঠবে সম্পাদকদের লেখনী।
শুধু বিশ্ব বা জাতির প্রশ্ন নয়, একটি বছর ফুরিয়ে যাওয়ার তাৎপর্য থেকে যায় ব্যক্তি-মানুষের জীবনেও। যে শিশুটি তিন পেরিয়ে চার বছরে পা দিতে চলেছে, তার মুখে কথার খই ফুটতে দেখে বাড়ির লোক আনন্দে-বিস্ময়ে পুলকিত। যিনি ছাত্র, তাঁর হয়তো অধ্যয়নের ক্ষেত্রে এক নতুন পর্বের শুরু। যে সব কর্মিষ্ঠ মানুষ কর্মজগতে ‘কদম কদম বঢ়ায়ে যা’ তালে পা ফেলছেন, তাঁরা হিসেব করছেন চাওয়া-পাওয়ার। আমার মতো প্রৌঢ় মানুষের মন অবসর গ্রহণ ও পেনশনের চিন্তায় গ্রস্ত। পরিতৃপ্ত মানুষ ‘কী পাইনি’, তার ‘হিসাব মিলাতে’ আর রাজি নন। আর যিনি অন্তর্জলী যাত্রার পথে ইতিমধ্যেই পা বাড়িয়েছেন, তাঁর মনে নিশ্চয়ই ‘হরি দিন তো গেল, সন্ধ্যা হল’-রই কোনও আধুনিক সংস্করণ বিলিতি জগঝম্প সুরে বাজছে!
সময়টা উৎসবেরও। ক্রিসমাসের সময় থেকে নববর্ষ পর্যন্ত হুল্লোড় চলবে। পার্টি, খানাপিনা জাতীয় ‘দ্বারকানাথ ঠাকুরী’ ব্যাপার তো আছেই। তার ওপর শুনি হিন্দু বাঙালি বাড়িতেও আজকাল বড়দিনের কেক খাওয়া ও ক্রিসমাসের গাছ সাজানোর হিড়িক পড়ে যায়। গোটা পৃথিবীর বড় বড় শহরগুলো আলো-ঝলমল বৃহত্তর পার্ক স্ট্রিট হয়ে ওঠে বা যেন পৃথিবী-জোড়া কলেজ স্কোয়্যারের পুজো! সিডনি থেকে নিউ ইয়র্ক, ব্রিজ বা উঁচু বাড়িঘর সব আলোয় সাজিয়ে, বাজি পুড়িয়ে, পথ-ঘাট আলোয় ভরে তুলে পুরনো বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে মানুষ যেন বিরাট, কালো, নিশ্ছিদ্র অন্ধকার, নক্ষত্রখচিত অনন্ত আকাশটাকে লক্ষ করে ঘোষণা করছে যে, কনেবধূটির মতো মেঘাবগুণ্ঠনবতী বসুন্ধরা তাঁর আরাধ্য সূর্যদেবকে প্রদক্ষিণ করে আরও এক পাক ঘুরে এলেন। সাত পাক তো নয়, লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি পাকের টানে তাঁদের জীবন দু’টি বাঁধা!
মাঝে মাঝে ভাবি, পৃথিবীটার কপাল! কত কোটি বছর ধরে অন্যান্য গ্রহের মতোই সূর্যের চার পাশে একটি সুতোয় বাঁধা লাট্টু হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অবিরাম এই চলা, যত দিন না সূর্য ফুরিয়ে আসে। বয়সও তো পৃথিবীর কম হল না। বিজ্ঞানীদের হিসেবে প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন, মানে সাড়ে চারশো কোটি বছর। পৃথিবীর বয়স তো! বিজ্ঞানীরা বলেন, তাঁদের হিসেবে পঞ্চাশ মিলিয়ন বছর ভুলচুক হওয়াও কিছু বিচিত্র নয়। আশ্চর্য নয় যে, কবির কল্পনায় চাঁদ বা পৃথিবীকে ‘বুড়ি’ লাগে। শুধু কবিকল্পনাই কেন, বিজ্ঞানীরা এও বলেন যে, পৃথিবীর আয়ুষ্কাল যদি আমরা একশো বছর ধরি, তা হলে আজ পৃথিবী আশি পেরিয়েছে। মানুষের হিসেবে বুড়িই বলতে হয়।
কিন্তু এত বছরের পুরনো এই যে পৃথিবী, তার সারা জীবন ধরে সূর্য প্রদক্ষিণ করে চলছে, তার জীবনেও কত পরিবর্তন হয়েছে! আমরা যদি মহাকাশের কোনও শূন্যে বসে পৃথিবীটাকে দেখতে পেতাম, তা হলে দেখতাম প্রাণ আসার আগে ও প্রাণ আসার পরে, গাছপালা আসার আগে ও গাছপালার আবির্ভাবের পরে পৃথিবীর রং ও চেহারা কত বদলেছে। কিন্তু বছর ঘোরার হিসেব তো মানুষের আগে কেউ করেনি। বর্ষশেষ নিয়ে গান বানানো— শচীনকর্তার সেই অসাধারণ ‘বছরখানি ঘুইর্যা গেল, গেল রে’— তা-ই বা কে করেছে মানুষ আসার আগে? কোথা থেকে মাত্র দুই কি তিন লক্ষ বছর আগে এল আমাদের প্রজাতির মানুষ, হোমো সেপিয়েন্স। সেই মানুষও মাত্র কয়েকশো বছর আগে শুরু করল কয়লার ব্যবহার। উনিশ শতকের শেষে এল বিদ্যুৎ। তার পর তো প্রযুক্তির জয়জয়কার। মানুষের সমাজ শিল্পায়িত ও বিশ্বায়িত হয়ে তবে না পৃথিবীর শরীরে এত আলোর গয়না উঠেছে!
মজা লাগে এটা ভাবলে যে, এই যে আমাদের এত বর্ষশেষের হিসেব ও নববর্ষের আগমনের উৎসব— ‘বিদায়বেলায় হাসি’ আর ‘আগমনীর বাঁশি’ কেমন মিশে যায় এই উৎসবে। সেই উৎসবের হেতু পৃথিবী, যে পৃথিবী ঘুরপাক না খেলে ‘বছর’ কথাটিরই কোনও মানে হত না, আমাদের উৎসব যেন তাকে উপলক্ষ করে মানুষকেই মুখ্য করে তোলে! আমাদের ভাবটা এমন, এই যে পৃথিবীটার বছরভ’র যাত্রা, সে যেন ‘সব আমাদের জন্য’! অথচ পৃথিবীর এই ঘুরপাক খাওয়ার সঙ্গে শুধু দিনরাত বা ঋতু পরিবর্তনেরই সম্পর্ক নেই, পৃথিবীর কক্ষপথে কাঁপন লাগে, সেই কাঁপনের ওপর নির্ভর করে গ্রহটি তুষারে ঢাকা পড়ে যাবে কি যাবে না। সেই পরিবর্তন আবার প্রাণিজগতের ইতিহাসেও পরিবর্তন ঘটায়।
মানুষের সংখ্যা ও দাপট যত বেড়েছে, যত তার সভ্যতার বিস্তার হয়েছে সারা পৃথিবীতে, প্রযুক্তির জালে যতই ধরে ফেলেছি গোটা গ্রহটিকে, ততই যেন আমরা ভুলতে বসেছি যে, পৃথিবীর প্রাকৃতিক নিয়মগুলিতে বেশি হাত লাগালে মানুষেরই মুশকিল। আজ মানুষের জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারের বাড়বাড়ন্তের ফলে পৃথিবীর যে শুধু জলবায়ু, আবহাওয়ার পরিবর্তন হচ্ছে, তা-ই নয়। সমুদ্রের জলের স্ফীতি হয়ে ও তাতে অ্যাসিড বেড়ে জীববৈচিত্রেরও সংকট ঘনিয়ে আসছে। কিছু বিজ্ঞানী বলেন, এই ভাবে পৃথিবীটাকে ভুলে থাকলে আর কয়েকশো বছরে মানুষ সমেত বহু জীব ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়াবে। ভূতাত্ত্বিকরা একটি নতুন কথার উদ্ভাবন করেছেন— প্ল্যানেটিসাইড বা গ্রহ-হত্যা। পৃথিবীর নিজস্ব ইতিহাস ও সেই ইতিহাসে মানুষের স্থান কোথায়, এ কথা স্মরণে না রেখে একটি প্রাণচঞ্চল গ্রহকে মানুষই প্রাণহীনতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এ সব শুনলে অনেকে প্রশ্ন করেন, তবে মানুষের মধ্যে আশার কিছু কি দেখেন না? আমি বলি, দেখি। মানুষের চরিত্রই আশার জন্ম দেয়। কারণ, মানুষ একটি জিনিস পারে, যা অন্য প্রাণী এত সচেতন ভাবে পারে না। মানুষ তার জ্ঞান, বুদ্ধি ও যুক্তির ব্যবহার করে নিজের ভুল বুঝতে পারে। প্রয়োজনে পথ বদলাতে পারে। বর্তমানে যাঁরা ক্ষমতাশীল, তাঁরা ভোগবাদী ধনতান্ত্রিক সমাজের স্বপ্নে অন্ধ। কিন্তু এই স্বপ্ন সকল মানুষের জীবনে বাস্তবায়িত হওয়ার নয়। হতে গেলে আরও চারটে পৃথিবীর রসদ লাগবে আমাদের। এই উপলব্ধি যত গভীর ও সাধারণ হয়ে উঠবে, মানুষের সমাজও তত নতুন ভবিষ্যতের সন্ধান করবে। ঔপনিবেশিক জীবনের সার্বিক সংকট এক সময় জন্ম দিয়েছিল মহাত্মা গাঁধীর। পরিবেশ ও জলহাওয়ার সংকট থেকেও এক দিন জন্ম নেবেন ভিন্ন ধরনের মানুষ, যাঁরা এই আবহাওয়া-প্রাণ-বৎসর-মানুষ সৃষ্টিকারী গ্রহটিকে শ্রদ্ধাসহকারে স্মরণে রাখার কথা বলবেন। ২২ এপ্রিল দিনটিকে বর্তমানে ‘পৃথিবী দিবস’ বলা হয়। এই দিনটি যা স্মরণ করে, তা কিন্তু মানুষেরই সৃষ্টি— পরিবেশবাদী আন্দোলন।
কিন্তু বছর তো সৃষ্টি করে পৃথিবী। তাই মনে হয়, ৩১ ডিসেম্বরই ‘পৃথিবী দিবস’ করলে হয় না? তা হলে আমাদের বর্ষবরণের উৎসব বুড়ি পৃথিবীর প্রতি মানুষের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যমও হয়ে উঠতে পারে।