সম্পাদকীয় ১

উভয়সংকট

ফ্রান্সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কট্টর দক্ষিণপন্থী ন্যাশনাল ফ্রন্টের নেত্রী মারিন ল্য পেনকে পরাস্ত করিয়া ইমানুয়ের মাক্‌রঁ-র জয় সংগত কারণেই বিশ্ব জুড়িয়া উদার গণতন্ত্রের সমর্থকদের অভিনন্দন কুড়াইয়াছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৭ ০০:০০
Share:

ফ্রান্সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কট্টর দক্ষিণপন্থী ন্যাশনাল ফ্রন্টের নেত্রী মারিন ল্য পেনকে পরাস্ত করিয়া ইমানুয়ের মাক্‌রঁ-র জয় সংগত কারণেই বিশ্ব জুড়িয়া উদার গণতন্ত্রের সমর্থকদের অভিনন্দন কুড়াইয়াছে। ইরানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল লইয়া উচ্ছ্বাস সেই তুলনায় অনেক কম। আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া অনেক সময়েই একটি ঘটনার গুরুত্ব মাপিবার উপযুক্ত মাপকাঠি নহে। ৫৭ শতাংশ ভোট পাইয়া হাসান রুহানির দ্বিতীয় বার প্রেসিডেন্ট পদ অর্জনের মূল্য কোনও অংশে কম নহে। বস্তুত, গণতন্ত্রের সামর্থ্য এবং সম্ভাবনা বিচার করিলে রুহানির জয়ের গুরুত্ব অনন্য। তিনি কেবল মধ্যপন্থী নহেন, ২০১৩ সালে প্রেসিডেন্ট হইবার পরে তিনি অনেক বাধার সম্মুখীন হইয়াও আপন পন্থা হইতে সরেন নাই। প্রধান বাধা ছিল অন্দরের। ‘ইসলামিক বিপ্লব’-এর প্রায় চার দশক পরেও ইরানের শাসনতন্ত্রে, বিশেষত, বিচারব্যবস্থা ও প্রতিরক্ষা বাহিনীতে কট্টরপন্থী ধর্মনায়কদের প্রভূত প্রতিপত্তি। হাসান রুহানির প্রতিদ্বন্দ্বী ইব্রাহিম রাইসি জয়ী হইলে ধর্মনেতারা খুশি হইতেন। কিন্তু ইরানের ভোটদাতারা অন্য রকম ভাবিয়াছেন। বস্তুত, কট্টরপন্থী রাইসি যাহাতে গদিতে আসিতে না পারেন, সে জন্য জনসাধারণের তাগিদ প্রবল ছিল বলিয়াই ভোটদানের হার ৭০ শতাংশ ছাড়াইয়া যায়, ইরানের মাপকাঠিতে যাহা ঐতিহাসিক। চরমপন্থীদের চাপ অতিক্রম করিয়া এই জয় গণতন্ত্রের, এবং গণতন্ত্রের জন্যও বটে।

Advertisement

চাপ ছিল বাহির হইতেও। প্রথমত এবং প্রধানত হোয়াইট হাউস হইতে। বারাক ওবামা বিস্তর কাঠখড় পুড়াইয়া ইরানের সহিত পারমাণবিক কর্মসূচি সংক্রান্ত চুক্তি সম্পন্ন করেন। ইরানের উপর মার্কিন তথা পশ্চিমী নিষেধাজ্ঞাগুলি ক্রমে শিথিল হইতে থাকে, বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতিতে ইরানের দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতা ক্রমে কাটিতে থাকে। কিন্তু ওবামা অতীত, ডোনাল্ড ট্রাম্প সব কিছু লন্ডভন্ড করিতে তৎপর। ইরান তাঁহার শত্রু-তালিকায় এক নম্বরে, তাহার বিরুদ্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট লাগাতার জেহাদ ঘোষণা করিতেছেন, ইজরায়েল হইতে আরব দুনিয়া— ইরানের প্রতিপক্ষীয় রাষ্ট্রনায়কদের উৎসাহিত ও উত্তেজিত করিতেছেন। দুনিয়ার প্রধান সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তির এই উন্মত্ত প্ররোচনা ইরানে চরমপন্থী প্রতিক্রিয়ায় উৎসাহ দিবে, ইহাই স্বাভাবিক। সেই তীব্র চাপের মুখে দাঁড়াইয়া নাগরিকরা রুহানিকে বিপুল ভোটে জয়ী করিয়াছেন, এই ঘটনার মূল্য ট্রাম্প না জানিতে পারেন, কিন্তু কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন যে কোনও মানুষ অবশ্যই জানিবেন।

রুহানির দায়িত্ব বিস্তর, তাঁহার কাজ কঠিন। তাঁহার সমর্থকদের অন্যতম দাবি, উদারতর গণতন্ত্র। বিশেষত রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং বাকি দুনিয়ার সহিত সম্পর্ক ও লেনদেনের প্রসার। দেশের ভিতরে কট্টরপন্থীরা এই দাবির বিরোধী, বাহিরে ট্রাম্প এই দাবি পূরণের পথ বন্ধ করিতে বদ্ধপরিকর। এই উভয়সংকটে রুহানির সমস্যার শেষ নহে, শুরু। তাঁহাকে দেশবাসীর আরও বড় দাবি মিটাইতে হইবে। অর্থনৈতিক উন্নতির দাবি, সেই উন্নতির ফসল সমস্ত নাগরিকের কাছে পৌঁছাইয়া দিবার দাবি। ইরানের অর্থনীতি বিপন্ন। দীর্ঘ নিষেধাজ্ঞা সেই বিপদকে বহুগুণ বাড়াইয়াছে। দারিদ্র, অসাম্য এবং বিশেষ করিয়া শহরের শিক্ষিত তরুণদের ব্যাপক কর্মহীনতা সমাজমানসে তীব্র অসন্তোষ জমাইয়া রাখিয়াIranছে। আর্থিক সমস্যার সুরাহা করিতে না পারিলে সেই অসন্তোষ অচিরেই বাড়িবে। আবার, ট্রাম্পের জঙ্গি বিরূপতা আর্থিক সমস্যা সুরাহার পথ বহুগুণ কঠিন করিয়া তুলিবে। অর্থাৎ, আবারও, উভয়সংকট। এই সংকট নিরসন করিয়া রুহানি ইরানকে গণতন্ত্রের পথে ধরিয়া রাখিতে পারিবেন কি না, তাহা এই মুহূর্তে অন্যতম বড় প্রশ্ন। কেবল ইরানের পক্ষে নহে, দুনিয়ার পক্ষে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন