দেশে ডাক্তার কম পড়ে গেছে। প্রায় দেড় হাজার লোকের স্বাস্থ্য রক্ষা করার জন্য এখন আছেন গড় হিসেবে মাত্র এক জন ডাক্তার। রক্ষাব্যবস্থা কৃশকায়, তাই ঠুনকো। ডাক্তার বেশি হলে নাকি লোকজনের স্বাস্থ্যও ভাল থাকে। তাই জনসংখ্যা অনুযায়ী ডাক্তারের সংখ্যা, হাসপাতালের সংখ্যা বাড়াতে হবে আর এত সব করতে গেলে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দও বাড়াতে হবে। কিন্তু সকলেই জানেন, কড়া-ক্রান্তি হিসেব-নিকেশ করে সরকারের সংসার চলে, অবস্থা বড় করুণ। অস্ত্রশস্ত্র জোগাড়যন্ত্র, সাজগোজ, ‘ভীষণ সব জরুরি’ কাজের পিছনে আমাদের এত খরচ হয়ে যায় যে হাতে আর থাকেই বা কী? তাই সামরিক বাহিনী স্থূলকায় হলেও ডাক্তার বাহিনী শীর্ণকায়। তা নিয়ে আর কত দূর এগোনো যায়?
এগোতে গেলে শ্রেষ্ঠী আর কারবারিদের হাত ধরতে হয়। তাদেরও আনন্দ ধরে না; তাই বেসরকারি হাসপাতালের সংখ্যা বাড়তে থাকল। একই সঙ্গে বাড়তে থাকল বেসরকারি ডাক্তারি কলেজও। হাসপাতাল তৈরি করার চেয়ে কলেজ তৈরি অবশ্য অনেক দুরূহ, কেননা সেখানে ডাক্তারির সর্বোচ্চ সংস্থার নজরদারি থাকে, নিয়মকানুনের বেড়াজাল থাকে। সরকারি কলেজের অনুমতি পেতেই প্রভূত হাঙ্গামা; অথচ নিয়ম না মেনেই, কী সব বিচিত্র ভোজবাজিতে বেসরকারি কলেজগুলো অনুমতি পেয়ে যায়। এতে সরকারের লাভ, ডাক্তারের উৎপাদন বাড়ে, ঘাটতি নিয়ে চক্ষুলজ্জা কমে। কিন্তু তাতেও অবস্থার তেমন হেরফের নেই। কী করা? আরও চাই বলে হাঁক পাড়লেও অঙ্ক যে মিলছে না।
সমাজ একটা জটিল রসায়ন, সরল অঙ্ক না। তাই ডাক্তারের সংখ্যা বাড়ালেই লোকজন স্বাস্থ্যবান হয়ে যায় না, তাদের প্রত্যাশিত আয়ুষ্কালও বাড়ে না। শুধু তো বাড়ানোই না, কমানোর কাজগুলোও আছে। তাই শিশুমৃত্যুর হার, প্রসবিনীর মৃত্যুর হার, অপুষ্টির হার, কোনওটাই কমে না। এগুলো ঠিক মতো কমাতে পারলেই স্বাস্থ্যবানের সংখ্যা বাড়ে। লোকের আর্থিক ক্ষমতা বাড়লে শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগও কিছুটা কমে। কিন্তু এগুলোর সঙ্গে ডাক্তারির কোনও সটান সংযোগ নেই। জনস্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে গেলে কয়েকটা বুনিয়াদি ব্যবস্থার দিকে নজর দিতে হয়, তিন বেলা আহার, পরিস্রুত পানীয় জল, মাথার ওপরে ছাদ, শৌচালয় আর নারীর হাতে আর্থিক ক্ষমতা। ডাক্তারের সংখ্যা বাড়িয়ে এগুলোর নাগাল পাওয়া যায় না।
সে সব কাজ অবশ্য স্বপ্নিল জল্পনা। তাই জনস্বাস্থ্য রক্ষার এই লম্বা ফিরিস্তিগুলো সরিয়ে রেখে আমরা শুধু চিকিৎসা পরিষেবার কথায় আসি। কিন্তু ডাক্তারের ঘাটতি কমিয়ে এ কাজটাও ঠিক মতো সম্পন্ন হয় না। কারণ, যেখানে দরকার বেশি সেখানে ডাক্তার কম, হাসপাতালও কম। পারিবারিক চিকিৎসক অনেক বেশি দরকার, অথচ জোগান নেই। সরকারি কলেজ থেকে যাঁরা বেরোচ্ছেন তাঁরা যেখানে দরকার সেখানে যাচ্ছেন না। তার বিবিধ কারণ; কিন্তু সমাধান নেই। তাই চিকিৎসা পরিষেবা ঘাটতিতে চলে। বেসরকারি কলেজ থেকে বেরোনো ডাক্তাররা কি এই ঘাটতি পূরণ করবেন? কোটি কোটি টাকা লগ্নি করে যাঁরা ডাক্তার বা পারদর্শী হয়েছেন তাঁরা কি অর্থনীতির স্বার্থ ভুলে লোকসেবায় মন দেবেন? বয়েই গেছে।
তা হলে ডাক্তার বাড়িয়ে সরাসরি তেমন লাভ হচ্ছে না। তাতে বরং লোকজনের বিপত্তি বাড়ে। বেশি ডাক্তার আর হাসপাতাল মানে বেশি বেশি ডাক্তারি। ডাক্তারির চলন আর পঠনপাঠন এখন এমন যে অতিরিক্ত ডাক্তারিই এখন দস্তুর। অথচ চিকিৎসা বা পরিচর্যায় পরিমিতিবোধ থাকা দরকার, সেটাই আধুনিকতা। তা এখন বিলীয়মান। তাই আধুনিক কালে পীড়িত মানুষজন একটা শারীরিক সংকট থেকে সাময়িক মুক্ত হয়ে নতুন সংকটে পড়েন। স্বাস্থ্যবান হওয়ার বদলে চিরপীড়িত থেকে যান। ডাক্তারি পত্রপত্রিকায় এমন আক্ষেপ বহু কাল ধরে চলছে। এখন কিন্তু তা আর আক্ষেপ না, বিষম দুশ্চিন্তার কথা, কারণ সারা দুনিয়াতেই চিকিৎসা-জনিত মৃত্যুর সংখ্যা মর্মান্তিক ভাবে বাড়ছে।
ডাক্তার কমে গেলে কি অমন বেঘোরে মৃত্যু কমবে? বলা মুশকিল, তবে অন্য একটা তাজ্জব অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। আমাদের দেশে তো বটেই, উন্নত দেশগুলোতেও নানা ন্যায্য দাবিতে মাঝে মাঝে ডাক্তারদের ধর্মঘট হয়। সরকারি দীর্ঘসূত্রিতায় কখনও কখনও সেগুলো দীর্ঘায়ু হয়ে যায়। তাতে তো লোকের বিপদ বাড়ার কথা। অথচ হিসেব নিয়ে দেখা গেছে, ওই সময় লোকের মৃত্যুহার বরং কমে যায়। এক সময় ইজরায়েল-এ সরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা প্রায় তিন মাস ধর্মঘট চালিয়েছিলেন। ওই সময় লোকের মৃত্যুহার কমেছিল প্রায় ত্রিশ শতাংশ। কফিন বিক্রতারাই বরং বিপদে পড়েছিল! এ সব দেখে-শুনে এক বিখ্যাত ডাক্তারি পত্রিকায় আলোচনা বসেছিল, ডাক্তারদের ধর্মঘট বোধ হয় স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালই।
সংখ্যা, আয়তন আর ব্যয়বাহুল্য দিয়ে স্বাস্থ্য রচনা করা যায় না। খরচখরচা আর মূল্যের অর্থ আলাদা। তাই প্রয়োজন আর জোগান সমান-সমান হলেই লোকে স্বাস্থ্যলাভ করে না। বরং অতিরিক্ততা পরিহার করে, সুষ্ঠু বণ্টন ব্যবস্থার দিকে নজর দেওয়াই বেশি জরুরি। আইনবিলাসী আর ভণিতাপ্রিয় সরকার এ সব কথা একটু ভেবে দেখলে মঙ্গল। নইলে এক দিন হয়তো আমরাই বলব, এক দল ডাক্তার মিলে কত রকম চিকিৎসাই না করলেন, তা সত্ত্বেও রোগী কিন্তু বেঁচেই উঠল!