এটাই ছিল লোকসভা নির্বাচনের আগে শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট। সেই ভোটেরও আগে মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, রাজস্থানের মতো বিজেপিশাসিত রাজ্যে নির্বাচন। গুজরাতে বিজেপির একেবারে কান ঘেঁষে গুলি বেরিয়েছে। গ্রামীণ এলাকায় বিজেপি এক-তৃতীয়াংশ আসন জিতেছে। সবচেয়ে বাজে ফল হয়েছে সৌরাষ্ট্র অঞ্চলে। সেখানে ৭৫% আসনই গ্রামীণ। সৌরাষ্ট্র কার্পাস চাষের এলাকা, ২০১২ সালের পর থেকে কার্পাসে মন্দা চলছে, দাম অর্ধেকের কম হয়ে গেছে। কয়েক বছর ধরেই রাজ্যে রাজ্যে কম দামের প্রতিবাদে চাষিরা রাস্তায় ফসল ফেলে বিক্ষোভ করেছেন। পুলিশের গুলিতে চাষির মৃত্যু হয়েছে। রাজস্থানের উপনির্বাচনেও বিজেপি প্রার্থীরা পর্যুদস্ত। আসন্ন নির্বাচনগুলো নিয়ে বিজেপির আরও বড় চিন্তা— মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ় বা রাজস্থান শহুরে চরিত্রের রাজ্য নয়। গ্রামের ভোটদাতাকে সন্তুষ্ট করতে না পারলে সেখানে বিপদ। ফলে, অরুণ জেটলির বাজেট জুড়ে কৃষক আর গ্রামাঞ্চলের উল্লেখ। প্রশ্ন হল, সেই বাজেট চাষের জন্য, গ্রামের জন্য কী দিল?
এখনও গ্রামীণ ভারতের ৬৪% লোক চাষের ওপর নির্ভরশীল। কৃষির দুরবস্থা আজকের নয়, প্রায় তিন দশক ধরেই চাষবাসের অবস্থা ভাল যাচ্ছে না। গত শতকের আশির দশক কৃষির সুসময় ছিল। ভূমিসংস্কার, ক্ষুদ্রসেচের প্রসারের দৌলতে পশ্চিমবাংলা কৃষিতে শীর্ষস্থানে উঠে আসে। তবে, শুধু এই রাজ্যে নয়, গোটা দেশেই আশির দশকে চাষবাসের উন্নতি হয়েছিল। নব্বইয়ের দশক থেকে অবস্থা বিগড়াতে শুরু করে। উৎপাদন বৃদ্ধির হার অর্ধেক হয়ে যায়। সংকট চরমে ওঠে ১৯৯৯ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে— কমতে থাকে উৎপাদন। দিল্লিতে তখন বাজপেয়ীর নেতৃত্বে এনডিএ সরকার।
ভারতের খাদ্য শস্যের এক-তৃতীয়াংশ সরকার সহায়ক মূল্যে কিনে নেয়। রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে কম দামে সেই শস্য ছাড়া হয়। সরকার ভাল সহায়ক মূল্য দিলে চাষির আয় বাড়ে। বাজারের দামের ওপরও সহায়ক মূল্যের প্রভাব পড়ে, ফলে অন্য চাষিরাও লাভবান হন। প্রথম ইউপিএ সরকার ২০০৭ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত সময়ে সহায়ক মূল্য অনেক বাড়িয়েছিল। তার পর থেকে অবস্থা তথৈবচ।
২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের সময় গ্রামীণ ভোটারদের মোদী কথা দিয়েছিলেন চাষের খরচের ওপরে ৫০% লাভ রেখে সহায়ক মূল্য ধার্য হবে। আশ্বাসমাত্র সার, সহায়ক মূল্য শম্বুক গতিতে বেড়েছে। অন্য দিকে, চাষের খরচ বেড়েই চলেছে। চাষির লোকসানও। এক সমীক্ষার ফল বলছে, দেশের ৪০% কৃষক চাষ ছেড়ে অন্য পেশায় যেতে চান। ২০১৬-র বাজেটে জেটলি কথা দিয়েছিলেন, পাঁচ বছরের মধ্যে চাষির আয় দ্বিগুণ করবেন। কৃষি উৎপাদন বাড়ছে বছরে ২% হারে, ফসলের বাজারে মন্দা, চাষির আয় দ্বিগুণ হবে কী করে? এই বাজেটে তাঁর প্রস্তাব, ফসলের সহায়ক মূল্য চাষের খরচের দেড় গুণ করা হবে, যাতে ৫০% লাভ থাকে। সহায়ক মূল্য বাড়ালে কৃষকের আদৌ লাভ হয় কি না, অন্য কোনও পথে সেই টাকাটাই খরচ করলে বেশি উপকার হত কি না, সেই তর্কগুলো থাকছে। মোদীর সরকারই ক্ষমতায় এসে জানিয়েছিল, সহায়ক মূল্য বাড়িয়ে লোক ভোলানোর খেলায় তারা নেই— তাদের লক্ষ্য, কৃষির ‘প্রকৃত উন্নতি’। কিন্তু, সে তর্ক বকেয়া থাকুক। অর্থমন্ত্রীর বাজেটপ্রস্তাবটি ঠিক কী, আপাতত সেই খোঁজ নেওয়া যাক। কোন খরচের দেড় গুণ হবে তাঁর সহায়ক মূল্য?
কৃষিতে একটা খরচ হয় নগদে বা অন্য সামগ্রীতে। সার, বীজ, কীটনাশকের দাম নগদেই দিতে হয়। এই খরচের নাম দেওয়া হয়েছে ‘এ টু’। আবার ভারতের ৯০% চাষি ছোট বা প্রান্তিক চাষি। নিজেরা খাটেন, জমি নিজের, পুঁজিও অনেক সময় নিজের। নগদ দিয়ে শ্রম কিনতে হয় না বা জমির ভাড়া দিতে হয় না। তবে এ-সবের মূল্য আছে, অর্থনীতির পরিভাষায় যাকে বলে ‘অপরচুনিটি কস্ট’। এই মূল্য ‘এ টু’-র সঙ্গে যোগ করলে পাওয়া যাবে প্রকৃত খরচ, যার নাম ‘সি টু’। সহায়ক মূল্য ‘সি টু’-র দেড় গুণ করা হবে, না ‘এ টু’-র— জেটলি বলেননি। দুটোর মধ্যে তফাত কিন্তু বিস্তর। দাম যদি ‘এ টু’-র দেড় গুণ করতে হয়, তা ইতিমধ্যে বহু শস্যের ক্ষেত্রে হয়েই আছে। নতুন কিছু করার নেই। যদি ‘সি টু’-র দেড় গুণ করার কথা ভাবেন, তা হলে বেশির ভাগ শস্যের জন্য সহায়ক মূল্যকে অনেকখানি বাড়াতে হবে। প্রায় দেড় গুণ। এক বছরে অতটা বাড়ানো কার্যত অসম্ভব। না কি, জেটলি এই দুই খরচের মাঝামাঝি থাকা ‘এ টু প্লাস এফ এল’-এর কথা বলেছেন, যাতে পরিবারের শ্রমের মজুরি ধরা থাকে?
কৃষির দীর্ঘকালীন উন্নতির জন্য দরকার ছিল সুচিন্তিত ও ব্যাপক পরিকল্পনা। সেচব্যবস্থা, বিদ্যুৎ, প্রশিক্ষণ, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, ঋণ, ফসল কেনার পরিকাঠামো— সব কিছুকে সামগ্রিক ভাবে, এবং সংহত ভাবে, মজবুত না করলে, সরকার কৃষির উন্নতিতে পুঁজি না ঢাললে, চাষের সংকট চলতেই থাকবে। একটা বাজেটে হয়তো এত কিছু করা যায় না। অন্তত স্পষ্ট দিকনির্দেশ দেওয়া যেত। তার বদলে পেলাম ঝাপসা কিছু আশ্বাস।
চাষিরা ধুঁকছেন কাজের অভাবেও। চাষি খালি চাষ করেন না, অনেকেই অ-কৃষি ক্ষেত্রেও কাজ করেন। বর্তমান ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতির মোট আয়ের ৪০%-ও কৃষির থেকে আসে না। কৃষিনির্ভর পরিবারগুলোর আয়ের এক-তৃতীয়াংশ আসে মজদুরি বা মাসমাইনে থেকে। গ্রামে কর্মসংস্থান কমছে। কৃষক কাজের খোঁজে শহরে, রাজ্যে ছুটছেন।
কাজের বাজারেও মন্দা। ২০১৭ সালে ২ কোটি লোক কাজ খুঁজছিলেন, আর কাজ তৈরি হয়েছিল মাত্র ২০ লক্ষ। মাসের পর মাস বেকার থাকলে অনেকে হাল ছেড়ে দিয়ে কাজ খোঁজা ছেড়ে দেন। জনসংখ্যার যত ভাগ লোক কাজ করছেন বা খুঁজছেন, সে সংখ্যাটা দিনকে দিন কমছে; বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে হুহু করে। ফলে মেয়েদের আর্থিক স্বনির্ভরতাও কমছে। সারা দেশে জনসংখ্যার মাত্র ৪৪% কাজ করেন বা কাজ খুঁজছেন। চিনে সংখ্যাটা ৭১%। কর্তারা সুযোগ পেলেই ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’-এর কথা বলেন— ভারত এখন দুনিয়ার তরুণতম দেশ। কমবয়সিরা কাজ করবেন, আয় করবেন, কর দেবেন, সরকার কল্যাণমুখী খাতে খরচ করবে, উন্নয়ন হবে— এমনটাই তো হওয়ার কথা। ২০১৪-য় প্রতিশ্রুতি ছিল বছরে এক কোটি লোকের কর্মসংস্থান। এখন পকোড়া বেচার পরামর্শ পাওয়া যাচ্ছে।
কর্মসংস্থানের নিরিখেও এই বাজেট আশা জাগায় না। ‘মহাত্মা গান্ধী গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প’ গ্রামে কাজ তৈরির প্রধান সরকারি উদ্যোগ। ২০০৬ থেকে প্রকল্প চলছে, সুফল শ্রমজীবীরা পেয়েছেন, মজুরির হার বেড়েছে। এই বাজেটে কিন্তু প্রকল্পের বরাদ্দ বাড়ানো হয়নি। মূল্যবৃদ্ধির হিসাব করলে বরাদ্দ কমেছে।
কর্মসংস্থানের দায় সরকার এখন বাজারের হাতে ছাড়তে চাইছে। পুঁজিপতির মুনাফা বাড়ানো হচ্ছে, হাতে বেশি টাকা থাকলে তারা লগ্নি করবে, উৎপাদন বাড়বে, লোকে চাকরি পাবে। কর্পোরেট করের হার ৩০% থেকে ২৫%-এ কমিয়ে জেটলি এই যুক্তিই দিয়েছেন। এর নাম ট্রিকল ডাউন থিয়োরি— তেলা মাথায় তেল দিলে কিছু তেল পায়ে চুইয়ে পড়বে। বাজেটে ঠিকামজুর নিয়োগকেও সরকার সিলমোহর দিয়েছে, যাতে সহজে শ্রমিক ছাঁটাই করা যায়। এই নীতির পিছনেও ‘শ্রমিকবান্ধব উদ্দেশ্য’ আছে— যদি পুঁজিপতি জানেন যে সহজে ছাঁটাই করা যাবে, তবে তাঁরা সহজে চাকরি দেবেন।
এই সুন্দর তত্ত্বের সমর্থনে অবশ্য তথ্য নেই। শ্রম আইন অনুযায়ী ১০০ জনের বেশি নিয়োগ করলে তবেই কারখানার মালিককে ছাঁটাই করতে গেলে হ্যাপা পোহাতে হয়। অথচ, বেশির ভাগ কারখানায় শ্রমিকের সংখ্যা একশোর ঢের কম। কাপড় শিল্পে কারখানাপ্রতি গড়ে ৮ জন শ্রমিক চাকরি করেন। কারখানাগুলো ৯৯ জনকে কেন চাকরি দিচ্ছে না কেন, তা হলেও তো শ্রম আইনের আওতায় পড়তে হয় না? কারখানাগুলো বাড়ছে না কেন?
সম্পদের চুইয়ে পড়ার আশায় না থেকে জেটলি এই প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজলে ভাল করতেন।
আইআইটি, গুয়াহাটি-তে অর্থনীতির শিক্ষক