শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া। — ফাইল চিত্র।
বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র তিন মাস বাকি। বাংলাদেশ আয়তনে ভারতের চেয়ে অনেক ছোট দেশ। কিন্তু এই মুহূর্তে বাংলাদেশের নির্বাচন ভারতের কাছে গভীর তাৎপর্য বহন করছে। যত ভোটের সময় ঘনিয়ে আসছে, ঢাকায় ইসলামপন্থী বিরোধী শিবির প্রচারাভিযানকে তীব্র থেকে তীব্রতর করে বলছে, এ বার ভোটে আওয়ামি লিগের পরাজয় সুনিশ্চিত। তার পরই প্রতিপক্ষ বলেছে, এই ভোটে তাই ক্ষমতায় থাকার জন্য ব্যাপক রিগিংয়ের আয়োজন করেছে ক্ষমতাসীন শাসক দল।
২০১৪ সালে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনপি) ভোট বয়কট করেছিল। সে বার তাদের দাবি ছিল কেয়ারটেকার সরকার গঠন করে ভোট হোক, যাতে ভোট নিরপেক্ষ হয় এবং শাসক দল ভোটকে প্রভাবিত করতে না পারে। এ বারও সেই একই কায়দায় বিএনপি কিছু সিভিল সোসাইটি গ্রুপ ও সংবাদপত্রের একাংশের সমর্থন নিয়ে আবার শেখ হাসিনার উপর চাপ সৃষ্টি করে যাতে তিনি ইস্তফা দিয়ে ভোট করান। যাতে ভোট হয় নিরপেক্ষ। স্বভাবতই শেখ হাসিনা এই প্রস্তাব মানতে কোনও ভাবেই রাজি নন। আওয়ামি লিগের বক্তব্য, গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত এ সরকার নির্দিষ্ট সাংবিধানিক সীমা উত্তীর্ণ হওয়ার পর আবার মানুষের ভোটের জন্য প্রস্তুত। ভোটে রিগিং হবে আর সংবাদমাধ্যম দেশের ও বিদেশের, তারা কিছুই জানতে পারবে না, দেখতে পাবে না? এমন হয়! আসলে হেরে যাওয়ার ভয়েই খালেদার দল এ কাজ করছে। বিএনপি পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশ, এমনকি ভারতের উপরেও এই ব্যাপারে নানা ভাবে চাপ দিচ্ছে।
বিএনপি ও জামাত যৌথ ভাবেই এই আক্রমণাত্মক প্রচারে নেমেছে। তবে ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) সাম্প্রতিক পাবলিক অ্যাটিচুড সার্ভে বলছে যে ভোটে আওয়ামি লিগ জিতবে। ব্লুস্টার নামের এক সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ মক্কেল হল বিএনপি। তারা পশ্চিমেও প্রচার চালাচ্ছে। এমনকি, খালেদা জিয়া ও তাঁর পুত্র তারিক রহমানকে অবিলম্বে ছাড়া না হলে গোটা বাংলাদেশ জুড়ে আক্রমণাত্মক আন্দোলন শুরু হয়ে যাবে, এ কথাও তারা বলেছে। মার্কিন সংস্থার সমীক্ষা অনুসারে, বাংলাদেশের ৬৬ ভাগ মানুষ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান। ১০ অক্টোবর এই সমীক্ষা আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশ করার কথা। এই আইআরআই সমীক্ষাটির খবর প্রথম করে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা। সেটিও চিত্তাকর্ষক ঘটনা। অনেকেই এই সমীক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, কেন এই সমীক্ষা আইআরআই ওয়েবসাইটে দেওয়া হচ্ছে না? তখন এটি ওয়েবসাইটে দিয়ে দেওয়া হয়। তখন প্রতিপক্ষ এই সমীক্ষার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। আইআরআই একটি অলাভজনক নিরপেক্ষ সংস্থা বলে পরিচিত। তবে এই রিপোর্টটি এই মুহূর্তে আওয়ামি লিগকে শক্তি দিয়েছে।
ঢাকা সাম্প্রতিককালে বহু বার গিয়েছি। একটা বিষয় নিয়ে আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই যে ঢাকায় বহু মানুষ খালেদা জিয়া, বিশেষত তাঁর পুত্রের লন্ডন থেকে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের কুপ্রয়াসের ঘোরতর বিরোধী। পুত্রের ভাবমূর্তি এতটাই কালিমালিপ্ত যে সামগ্রিক ভাবেই মানুষ আতঙ্কিত খালেদা-পুত্রের জন্য।
স্থল সীমান্ত চুক্তির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের চাপে অসম বিজেপির বক্তব্যকে গুরুত্ব না দিয়ে মোদি চুক্তি করেছেন।ফাইল চিত্র।
খালেদা মানে তো শুধু খালেদা বা তাঁর পুত্র নন। সঙ্গে আছে জামাত। লন্ডনেও জামাত ও তারিক যৌথ ভাবে সক্রিয়। এই তো কিছু দিন আগে লন্ডনের আইনজীবী লর্ড আলেকজান্ডার কার্লাইল-কে ভারতে পাঠিয়ে সাংবাদিক বৈঠক করানোর চেষ্টা হয়। তখন দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মুজতবা আলির ভাইপো সৈয়দ মুয়াজ্জেম আলি সক্রিয় ভূমিকা নেন। তিনি ভারত সরকারের উপর তীব্র চাপ সৃষ্টি করেন। জামাতের ওই প্রবীণ ব্রিটিশ আইনজীবী সম্পর্কে অনেক তথ্য দেন। জানা যায়, তিনি যে পাসপোর্ট ও ভিসা নিয়ে আসছেন, সেই কাগজপত্রেও ভারতে আসার সঠিক কারণ জানানো হয়নি। তিনি আদপে টুরিস্ট ভিসা নিয়ে ভারতে আসছিলেন। দিল্লি প্রেস ক্লাবে তাঁর সাংবাদিক সম্মেলনের কথা ঘোষণাও করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে দিল্লি বিমানবন্দর থেকেই লন্ডনে ফেরত পাঠায়। দিল্লির যুক্তি ছিল, টুরিস্ট ভিসায় এ দেশে এসে তিনি কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে শামিল হতে পারেন না।
আরও পড়ুন: রাফাল চুক্তি এবং উত্তরহীন কয়েকটি প্রশ্ন
আরও পড়ুন: ভোট আসছে, কাশ্মীর সমস্যার সমাধান খোঁজার সময় ও ইচ্ছা কই?
ভারতের কাছেও এখন ঢাকার অনুরোধ শোনা বিশেষ ভাবে জরুরি। বাংলাদেশও মনে করে, ছোট দেশ হলেও তাদের বিদেশনীতি এখন যথেষ্ট আক্রমণাত্মক। ঠিক একই ভাবে রোহিঙ্গা ইস্যুতেও নরেন্দ্র মোদীর অবস্থান বদলাতে মুয়াজ্জেম সাহেব দিল্লিতে বসে যথেষ্ট সক্রিয় ভূমিকা নেন। বাংলাদেশ হাইকমিশনের দিল্লি টিম মোদী সরকারকে বোঝায়, হতে পারে মায়ানমারের উপর চিনের নিয়ন্ত্রণের কথা ভেবে ভারত সুর নরম করছে। কিন্তু রাষ্ট্রসঙ্ঘ থেকে শুরু করে সামগ্রিক আন্তর্জাতিক দুনিয়া যখন ঢাকার পাশে, তখন ভারত পুরনো বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও রোহিঙ্গা নিয়ে চিনপন্থী অবস্থান নিতে পারে না। ভারতও বোঝে তাতে বিপদ ভারতেরই।
এর আগে স্থল সীমান্ত চুক্তির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের চাপে অসম বিজেপির বক্তব্যকে গুরুত্ব না দিয়ে মোদি চুক্তি করেছেন।
নির্বাচনের মুখে তাই আর যা-ই হোক, জামাতকে অক্সিজেন দেওয়া যাবে না। বিএনপি-র সংসদীয় দল ও আরও কয়েক জন খালেদা দূতও সম্প্রতি দিল্লি এসে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে ভারত যদি খালেদাকে পূর্ণ সমর্থন করে তবে খালেদা জামাতকেও পরিত্যাগ করতে পারে।
বিএনপি ব্যবসায়ীদের দল। বাণিজ্যের স্বার্থে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে চায়। দিল্লি এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি কারণ খালেদা জামাত ও মৌলবাদীদের সঙ্গে সম্পর্ক পরিত্যাগ করবেন এ কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
আইআরআই সমীক্ষার ৩৩ পৃষ্ঠার রিপোর্টে বলা হয়েছে যে শতকরা ৬২ ভাগ মানুষ মনে করেন দেশ সঠিক পথে চলেছে। শতকরা ৬৯ ভাগ মানুষ বর্তমান অর্থনীতি নিয়ে সন্তুষ্ট। শতকরা ৫৭ ভাগ মানুষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও খুশি। ২০১৫ সালেও আইআরআই সমীক্ষা করেছিল। এ ভাবে তাতেও রিপোর্ট ছিল ইতিবাচক। ২০১৫ সালে ব্রিটিশ কাউন্সিল, অ্যাকশন এড বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের ইউনিভার্সিটি অব লিবারাল আর্ট যে সমীক্ষা করে তাতে শতকরা ৭৫ ভাগ যুব সমাজ মনে করে, আগামী ১৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ আরও উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে। শতকরা ৫২ ভাগ মানুষ হাসিনার পক্ষে।
এই রিপোর্ট ইতিবাচক। তবে ভোটের ফলে এই সমীক্ষা শেষ পর্যন্ত প্রতিফলিত হবে তো? মৌলবাদী শক্তি ও আন্তর্জাতিক এক দুষ্টচক্রের চক্রান্ত সফল হবে না তো?