বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ভারতের উদ্দেশে বলেন প্রতিবেশীদের দিকে সযত্ন নজর দিতে, তখন দিল্লির বৈদেশিক দফতরের দুইটি কারণে কথাটিকে গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করা উচিত। প্রথম কারণ, গত চার বৎসরের মোদী রাজত্বের অবকাশে ভারতের সহিত সকল প্রতিবেশী দেশের সম্পর্কই পূর্বাপেক্ষা মন্দ হইয়াছে, পূর্বে পশ্চিমে উত্তরে। এমনকী ভারতের এ-যাবৎ উপগ্রহ-তুল্য দেশ ভুটানের সঙ্গেও! দিল্লির তরফে ইহা কম ‘কৃতিত্ব’ নয়! প্রতিবেশী দেশগুলিতে ইহা লইয়া অপ্রীতি ও উৎকণ্ঠা যথেষ্ট ছড়াইয়া পড়িয়াছে। প্রতিবেশীরা নিজেরাই বিভিন্ন ভাবে ও ভাষায় ভারতের প্রতি সতর্কবাণী পাঠাইতেছে। আঞ্চলিক স্থিতির জন্য এবং বৃহত্তর আন্তর্জাতিক ভারসাম্যের খাতিরে দিল্লির উচিত, অবশ্যই বিষয়টি আবার গোড়া হইতে তলাইয়া দেখা। দ্বিতীয় কারণ, ভারতের সামনে ‘চিন’ নামক যে মূর্তিমান চ্যালেঞ্জ, তাহার সামনে এই প্রতিবেশী-সমস্যাটি আরওই সংকটময়। এক দিকে ভারতের চার দিক ঘিরিয়া চিনের প্রভাব-বলয় কিংবা, ভূরাজনৈতিক পরিভাষায়, মুক্তাহার-ফাঁস ক্রমেই কঠিন ভাবে চাপিয়া বসিতেছে, অন্য দিকে ভারত নিজের জেতা জমিটি ক্রমশ হারাইতেছে। এই কঠিন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশই আপাতত ভারতের সর্বাপেক্ষা বন্ধুভাবাপন্ন প্রতিবেশী। চিনের নিকট বিপুল পরিমাণ সহায়তা লওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের হাসিনা সরকার এখনও ভারতের সম্পর্ক-নৈকট্যে টোল পড়িতে দিতে রাজি নয়। ফলে, ঢাকা যখন দিল্লির উদ্দেশে কোনও বার্তা দেয়, দিল্লির উচিত কান পাতিয়া তাহা শোনা, এবং তাহাকে যথাসম্ভব মান্য করা। কেবল নিয়মিত সফর করিলেই কোনও দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল হয় না, তাহার জন্য বিতর্কিত ক্ষেত্রগুলিতে নিয়মিত মনোযোগ দিতে হয়। দিল্লি অনেক সময়ই এই কাজটির গুরুত্ব বুঝিয়া উঠিতে পারে না।
শেখ হাসিনা খোলসা করিয়াই বলিয়াছেন, চিন যতই বিনিয়োগ করুক না কেন তাঁহার দেশে, ভারতের উদ্বেগের কোনও কারণ নাই। তবে কি না ভারতের উচিত, দ্বিপাক্ষিক সমস্যাগুলিতে আর একটু মন দেওয়া। বুঝিতে অসুবিধা নাই, এই সমস্যার মধ্যে একটি যদি হয় রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট, আর একটি তিস্তা জলবণ্টন, অন্য একটি কারণ তবে অসমের বেআইনি ‘অনুপ্রবেশকারী’দের জাতীয় নথিভুক্তকরণ সংক্রান্ত টানাপড়েন। শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার সদস্য, স্বয়ং তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু মন্তব্য করিয়াছেন যে বাংলাদেশ-অসম সীমান্ত অঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্গমতার বিষয়টি মনে রাখিলে বুঝিতে পারা যায় কেন অসমে গিয়া বাংলাদেশিদের পক্ষে বসবাস শুরু করা মোটেই সহজ বা সম্ভব নয়। তিনি এমনও বলিয়াছেন যে ইহা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়, সুতরাং তাঁহারা বেশি মাথা ঘামাইতে চান না, প্রত্যক্ষ মন্তব্য করিয়া বিতর্কে উসকানি দিতেও চান না।
এই মনোভাবটি প্রশংসনীয়। বাংলাদেশের মতো জরুরি মিত্রের কাছ হইতে এই আচরণই দিল্লি আশা করিতে পারে। এবং আশানুরূপ ব্যবহার লাভ করিয়া প্রসন্ন হইতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে দিল্লিকে ভাবিতে হইবে, কী কী উপায়ে তাহারা এই মৈত্রীবোধটিকে আরও জোরদার করিতে পারে, বিশেষ করিয়া যখন বহু প্রতিকূলতার সামনে সে দেশের মিত্রভাবাপন্ন শাসক দল আওয়ামি লিগ অচিরেই আবার নির্বাচন-পরীক্ষার মুখোমুখি হইতে চলিয়াছে। রোহিঙ্গা বিষয়ে দিল্লির নীতি-বৈকল্য লইয়া ইতিমধ্যেই নানা ক্ষোভ। ভারতের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে চিন মায়ানমার ও বাংলাদেশের সহিত যুগপৎ কূটনৈতিক সক্রিয়তার মাধ্যমে অনেকটা অগ্রসর হইয়া গিয়াছে। ভারত কেবল ঘুমাইয়া রয়। কিংবা কর্তব্য কী, লক্ষ্যই বা কী, ইত্যাদি স্থির করিতে না পারিয়া গভীর দ্বন্দ্বদ্বিধায় ভাসিতে থাকে।