গত কয়েক দশক জুড়িয়া রাষ্ট্রপুঞ্জে কাশ্মীর প্রসঙ্গ উঠিলেই একটিমাত্র ছবি দেখা গিয়াছে— ভারত ও পাকিস্তান দাঁতনখ বাগাইয়া পরস্পরের দিকে ধাবিয়া যাইতেছে। পারস্পরিক চুলাচুলির এই সুদীর্ঘ ইতিহাসের প্রেক্ষিতেও বলিতে হইবে, এই বার জেনিভায় ভারতের বক্তব্যে যে তিক্ততা, তাহা বিশেষ উচ্চগ্রামের। কারণটি অনুমান করা কঠিন নয়। রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্টে এই বারই প্রথম স্পষ্টাক্ষরে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে কাশ্মীর উপত্যকায় অশান্তি, সংঘর্ষ জিয়াইয়া রাখিবার ও মানবাধিকার দলন করিবার অভিযোগটি উঠিয়াছে, এবং তাহার ঠিক পর পরই ভারতের পক্ষ হইতে পাকিস্তানের সমালোচনা করিবার অবকাশ মিলিয়াছে। স্বভাবতই পাকিস্তানের দায়িত্বহীনতার সমালোচনার পরতে পরতে মিশাইতে হইয়াছে ভারতবিরোধী সমালোচনার যাবতীয় কাটান-সমূহ। স্বরটি স্বভাবতই তাই আগের অপেক্ষা তীক্ষ্ণতর। পাকিস্তান যে কাশ্মীরিদের নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেরা নির্ণয় করিবার কথা বলিতেছে, তাহা যে একান্ত ভাবেই ভারতবিরোধী চক্রান্ত, সেই বক্তব্যের সঙ্গে যুগপৎ মিশিয়াছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সিন্ধুপ্রদেশ, বালুচিস্তান ও খাইবার-পাখতুনখোয়া অঞ্চলে অবিরত মানবাধিকার হননের অভিযোগ। যে রাষ্ট্র নিজে এত দোষে দোষী, সে কোন অধিকারে অন্যের দিকে আঙুল তোলে— দিল্লির তীক্ষ্ণ প্রশ্ন।
প্রশ্নটি অসার নহে। কিন্তু প্রশ্ন করিবার ধরনটি সমস্যাজনক। কাশ্মীর-অশান্তি বিষয়ে পাকিস্তানের ভূমিকা যে নেতিবাচক, জানিতে কাহারও বাকি নাই (প্রসঙ্গত, রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্টে দুই দেশকেই একত্রে ভর্ৎসনা করা হইয়াছে)। কিন্তু পাকিস্তানের দিকে আঙুল তুলিবার সঙ্গে সঙ্গে কি এমন দাবি করা চলে যে ভারতীয় সেনাবাহিনী কোনও আতিশয্য ঘটায় নাই, মানবাধিকার হরণের কোনও উদাহরণ তৈরি করে নাই? গত তিন বৎসরে সেনাবাহিনী উপত্যকায় জঙ্গি দমনের পাশাপাশি লাগাতার নাগরিক সমাজের প্রতি আক্রমণ শানাইয়াছে। কারণ দর্শানো হইয়াছে, তরুণ জঙ্গি নেতা বুরহান ওয়ানির হত্যার পর হইতেই বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ সেনাবাহিনীর দিকে অতিরিক্ত বিদ্বেষ পোষণ করিতেছে, সেনার দিকে পাথর ছুড়িতেছে। বিদ্বেষ ও পাথর ছোড়া, উভয়ই সত্য ঘটনা। কিন্তু পাল্টা আক্রমণে কত দূর যাওয়া যায়, সে বিষয়ে ভারতীয় বাহিনী যাবতীয় আন্তর্জাতিক রীতি লঙ্ঘন করিয়াছে, ইহাও তো প্রমাণিত সত্য। নাগরিককে সাঁজোয়া গাড়িতে বাঁধিয়া মানবঢাল তৈরি, আন্তর্জাতিক রীতিসম্মত নহে। পেলেট ছুড়িয়া সহস্র মানুষকে অন্ধ করিয়া দেওয়াও রীতিসম্মত নহে।
অনেক সময় অসঙ্গত আত্মশ্লাঘা সঙ্গত সমালোচনাকেও ম্লান করিয়া দেয়। রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্টের বিরুদ্ধে দিল্লির প্রতিক্রিয়াটি তেমন এক দৃষ্টান্ত। পাকিস্তানকে ধমক দিয়া দেশ-বিদেশের সমস্ত রিপোর্ট ও বিশ্লেষণকে চুপ করিয়া দেওয়া যায় না। ২০১৬ সাল হইতে আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমে ভারতকে কম বার সতর্ক করা হয় নাই। কিন্তু জাতীয়তাবাদের পূর্ণ আবেগে কাশ্মীর সমস্যাকে ভাসাইয়া দিয়া কেন্দ্রীয় সরকার জনসমর্থনের তরঙ্গ তুলিতে ব্যস্ত থাকিয়াছে। কাশ্মীর যে একটি গুরুতর ‘রাজনৈতিক’ সঙ্কট, কেবল সামরিক প্রক্রিয়ায় যে তাহার সমাধান অসম্ভব— ঘরোয়া রাজনীতিতে বেশি নম্বর তুলিতে গিয়া সেই বাস্তবকে অস্বীকার করা হইয়াছে। এই ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক প্রক্রিয়ায় সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত কাশ্মীরিরা— রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্টে যে বিষয়টির উপর বিশেষ জোর দেওয়া হইয়াছিল। জেনিভায় সদ্য-প্রকাশিত বক্তব্যে স্পষ্ট: পাকিস্তানকে কয়েক হাত লইতে গিয়া কাশ্মীরিদের উপর অ-মাতৃসুলভ ব্যবহার চালাইবার অধিকার দাবি করিতেছে ভারত। ইহার পরও কাশ্মীরকে ভারতেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ বলিবার নৈতিক অধিকার থাকে তো?