মানবতাবাদই ছিল তাঁদের ধর্ম

ঐতিহ্য ও রাজনীতির টানাপড়েন সম্পর্কে ইতিহাসবিদ সুগত বসুআমরা যেন জোর গলায় বলতে পারি সঙ্কীর্ণ বিরোধিতার রাজনীতি থেকে আমাদের এত কালের মানবতাধর্মী রাজনীতি অনেক বেশি মূল্যবান, অনেক বড় মাপের উত্তরাধিকার।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৮ ০০:১৮
Share:

উদার-বন্দনা: মহাজাতি সদনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র বসু ও সুভাষচন্দ্র বসু, কলকাতা, ১৯৩৯

প্রশ্ন: এ দেশে যাঁরা রাষ্ট্রবাদী ধর্মনিরপেক্ষতা চর্চা করেছেন, তাঁরা ধর্ম সম্পর্কে যে কোনও ভাবনাকেই ঠেলে দূরে সরিয়ে দিতেন বলে ধর্ম বিষয়টা পুরোপুরি ধর্মান্ধদের কবলে চলে গিয়েছে— বলছিলেন আপনি। (‘ইতিহাসকে ‘ব্যবহার’ করতে চাইলেই...’, ৬-৭) এই প্রসঙ্গে আমার একটা আশার কথা বলি। বাঙালি সমাজে তো একটা অন্য ধর্মভাবের শিকড়ও যথেষ্ট গভীর— যাকে বলতে পারি ধর্মীয় মানবতাবাদ? আপনি দেশবন্ধু-সুভাষচন্দ্রের রাজনীতির উত্তরাধিকার উল্লেখ করলেন। তেমনই, সামাজিক ক্ষেত্রে ধর্মমুখী কিন্তু মানবতাবাদী চিন্তাধারা বাঙালি পেয়েছে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের কাছ থেকে। মানবধর্ম পালনের কথা সে শুনেছে রবীন্দ্রনাথের কাছেও। তাই আশা জাগে, সমাজটাকে ধর্মীয় বিরোধিতার কাচের মধ্য দিয়ে না দেখে তাকে বরং মিলনের ক্ষেত্র হিসেবে দেখার শুভবোধ হয়তো বাঙালির মধ্যে জাগ্রত হবে। কী মনে হয়, এমন একটা আশা কি বাড়াবাড়ি?

Advertisement

সুগত বসু: না, নিশ্চয়ই এমন একটা আশার জায়গা আছে, আমি বলব। ‘রিলিজিয়ন অব ম্যান’-এর বিবিধ ভাষ্য আমরা পেয়েছি বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের ভাবনায়। এঁদের পরস্পরের চিন্তাধারার মধ্যে অনেক তফাত আছে ঠিকই। কিন্তু তা সত্ত্বেও এঁদের ভাবনায় কোথাও একটা সাধারণ ঐক্যও আছে। বাঙালি সমাজের বিভিন্ন স্তরে সেই চিন্তাধারার প্রভাবটা বেশ গভীরপ্রসারী। রাজনীতির মধ্যেও সেই উত্তরাধিকার আমরা দেখতে পাই। অরবিন্দ, বিপিন পাল একটা ধর্মীয় মানবতাবাদের রাজনীতির কথা বলতেন। আবার দেশবন্ধু এবং সুভাষচন্দ্রের কথাও মনে রাখতে হবে, যাঁরা বহির্জীবনে বিরাট মাপের রাজনৈতিক নেতা আর ব্যক্তিজীবনে ধর্মপ্রাণ হিন্দু ছিলেন।

প্র: দেশবন্ধু তো ধর্মবিশ্বাসের দিক দিয়ে বৈষ্ণব ভাবাপন্ন ছিলেন। সুভাষচন্দ্রের ধর্মজীবনের কথাটা যদি একটু বলেন...

Advertisement

উ: সুভাষচন্দ্রের মধ্যে নানা ভক্তিভাবের চলাচল ছিল। তিনি যখন মান্দালয়ে ছিলেন, তখন তাঁর প্রিয় গানের মধ্যে লিখে রেখেছিলেন ‘কহ্না জীবনধনবৃন্দাবনপ্রাণ’: সেখানে তো কৃষ্ণের প্রতি ভক্তির কথাই আছে। আবার তিনি একটু কালীভক্তও ছিলেন। কলকাতার বাসভবন থেকে তাঁর মহানিষ্ক্রমণের আগে আমার বাবা (শিশিরকুমার বসু) ও বাবার বোন ইলাকে তিনি দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে পুজো দিয়ে আসতে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু প্রকাশ্যে ধার্মিকতা দেখানো তিনি একদম পছন্দ করতেন না। তাই, এই যে এখনকার তথাকথিত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ নেতারা মন্দিরে মন্দিরে ঘুরছেন, এটা উনি কখনও করার কথা ভাবতেন না। ধর্ম যা কিছু, সে সব ছিল ওঁর ব্যক্তিগত বিশ্বাস। সিঙ্গাপুরেও রামকৃষ্ণ মিশনে বসে ধ্যান করতেন, কিন্তু লোকের সামনে দেখাতেন না। যখন একটা জাতীয় সমাবেশ হত, সেটা চেট্টিয়ার মন্দিরে হলেও সব ধর্মের সব জাতির মানুষকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। তাঁর পাশে থাকতেন মহম্মদ জ়ামান কিয়ানি বা আবিদ হাসান। ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি হয়েও কী ভাবে ধর্মের প্রতি কোনও পক্ষপাত না দেখিয়ে রাজনীতি করা যায়, এই সব নেতা দেখিয়ে গিয়েছেন। বাংলার মুসলমান, বা গোটা ভারতের শিখ, খ্রিস্টানরা সেই জন্যই তাঁদের প্রতি ভরসা রাখতে পেরেছিলেন।

প্র: এখন যে বিভেদ ও অনৈক্যের আবহ চার দিকে, তা কাটিয়ে ওঠার আশা আছে তা হলে?

উ: আসলে এক-একটা সময় আসে যখন এই ধরনের ধর্মান্ধতা বা প্রেজুডিস অনেক বেশি করে সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। আমরা এখন এমন একটা সময়ের মধ্য দিয়ে চলেছি। মাঝে মাঝে ভয় হয়, ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে অগস্ট পর্যন্ত কলকাতার হিন্দু মধ্যবিত্তের মনোভাব যে ভাবে পাল্টে গিয়েছিল, তারই যেন প্রতিফলন আজকের বাংলাতেও। হিন্দু মুসলমান উভয়ের মধ্যেই এই মনোভাব ছড়িয়ে পড়ে। মুসলিমরা ১৯৪৬ সালে মুসলিম লিগকেই ভোট দেন। অথচ ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের পর ১৯৫৪ সালে মুসলিম লিগ হেরে গেল, জিতল আওয়ামি লিগ আর কৃষক শ্রমিক পার্টি। মাত্র পাঁচ-সাত বছরের ব্যাপার। সেই রকমই, হিন্দু মহাসভার মনোভাব হিন্দু মধ্যবিত্তের মধ্যে যদিও গেঁড়ে বসে ’৪৭ সালের অল্প কয়েকটি মাসের মধ্যে, দুর্দশাগ্রস্ত হিন্দু উদ্বাস্তুরা কিন্তু হিন্দু মহাসভা বা জনসঙ্ঘ কাউকে সমর্থন করলেন না, কংগ্রেসকেও না। বামপন্থার অনুসারী হলেন তাঁরা। তাই মনে হয়, এই সময়গুলো ভয়ের, তবু আমাদের ধর্মীয় মানবতাবাদের ঐতিহ্যটা এত গভীর যে হয়তো এই ধরনের সঙ্কীর্ণ রাজনীতি দীর্ঘস্থায়ী হবে না। তবে, সঙ্কটের মুহূর্তগুলোয় আমাদের সাধারণ নাগরিকদের অনেক বেশি রাজনৈতিক সচেতনতা দেখাতে হবে, মানবতাবাদী চিন্তাধারাটা ধরে রাখতে হবে। দেশবন্ধু-সুভাষচন্দ্রের দেখিয়ে যাওয়া পথে রাজনীতি করতে হবে।

প্র: আপনার এই সাবধানবাণীটি খুব জরুরি...

উ: রবীন্দ্রনাথের একটি সাবধানবাণী বলি তবে। ১৯৩৯ সালের অগস্টে মহাজাতি সদনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে সুভাষচন্দ্র রবীন্দ্রনাথকে এই জাতীয় যজ্ঞে পৌরোহিত্য করার আমন্ত্রণ জানান। তাঁরা দু’জনেই চান, বাঙালি জাতি যেন সেই রাষ্ট্রশক্তির আহ্বান করে যা শত্রু মিত্র কারও মনে কোনও ভয় ও সংশয় উদ্রেক করবে না। রবীন্দ্রনাথ বক্তৃতায় বলেন, ‘‘জাগ্রত চিত্তকে আহ্বান করি, যার সংস্কারমুক্ত উদার আতিথ্যে মনুষ্যত্বের সর্বাঙ্গীণ মুক্তি অকৃত্রিম সত্যতা লাভ করে।’’ এই ‘মনুষ্যত্বের সর্বাঙ্গীণ মুক্তি’র কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।আমরা যেন জোর গলায় বলতে পারি সঙ্কীর্ণ বিরোধিতার রাজনীতি থেকে আমাদের এত কালের মানবতাধর্মী রাজনীতি অনেক বেশি মূল্যবান, অনেক বড় মাপের উত্তরাধিকার।

সাক্ষাৎকার: সেমন্তী ঘোষ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন