প্রবন্ধ ১

ভারতের নেতাদের ইংরেজি সংকট

ইংরেজি নিয়ে বিদ্বেষ প্রকাশ করতে দক্ষিণ, মধ্য, বাম কোনও দল ছাড়ে না। ভাষাটার মধ্যে ‘জাতীয়তাবাদ’ নেই। একটা ‘এলিট’ গন্ধ আছে। তাই তাঁঁরা ইংরেজি শিক্ষায় উৎসাহ দেন না। অন্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভারতকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যও নয়।ইংরেজরা ভারত ছেড়েছে, তা বেশ কিছু দিন হল! আমাদের ছেলেমেয়েদের কাছে ‘ইংরেজ শাসন’ কথাটা ইতিহাস মাত্র। হলে কী হবে, এ দেশের রাজনীতিকরা এখনও মান্ধাতার ইংরেজদের নিয়ে পড়ে আছেন। ইংরেজ বলতে যা কিছু বোঝায়, সে সব নিয়ে ঘন ঘন দুর্ভাবনায় পড়ছেন। যেমন, ইংরেজি ভাষা।

Advertisement

ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০১৫ ০০:১৭
Share:

নতুন প্রজন্ম, নতুন মন? মুলায়ম সিংহ যাদব (বাঁ দিকে) ও অখিলেশ যাদব। ছবি: রাজেশ কুমার।

ইংরেজরা ভারত ছেড়েছে, তা বেশ কিছু দিন হল! আমাদের ছেলেমেয়েদের কাছে ‘ইংরেজ শাসন’ কথাটা ইতিহাস মাত্র। হলে কী হবে, এ দেশের রাজনীতিকরা এখনও মান্ধাতার ইংরেজদের নিয়ে পড়ে আছেন। ইংরেজ বলতে যা কিছু বোঝায়, সে সব নিয়ে ঘন ঘন দুর্ভাবনায় পড়ছেন। যেমন, ইংরেজি ভাষা। এই তো সে দিন আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দেখা গেল, ইংরেজি নিয়ে আবার নতুন করে বিষোদ্গার করতে নেমেছেন।

Advertisement

‘‘আংরেz হওয়ার চেষ্টা কোরো না,’’ কলেজ-ছাত্রদের সভায় তাঁর অগ্নিগর্ভ হুঙ্কার। একটু আগেই তাদের কেউ কেউ ইংরেজিতে কথা বলার দুঃসাহস দেখিয়ে ফেলেছিল। আর যাবে কোথায়, মন্ত্রী একদম টং। ‘‘খুব দরকার না হলে ইংরেজি বলবে না তোমরা!’’

না, রাজনাথ সিংহ প্রথম নন, শেষও নন। কারণে অকারণে ইংরেজি ভাষা নিয়ে বিদ্বেষ প্রকাশ করতে দেশের অনেক রাজনীতিকই ছাড়েন না। দেখেশুনে বোঝা যায়, এ দেশের রাজনীতিতে ইংরেজি ভাষার ভূমিকাটা খুব গোলমেলে। অনিশ্চিত। ইংরেজির প্রতি বিদ্বেষ বা ইংরেজি নিয়ে অশান্তি কেন ভারতীয় রাজনীতিকদের মধ্যে এত বেশি? দুটো কারণ। কারণ-দুটোর মধ্যে যোগাযোগও যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ। প্রথম কারণটি আদর্শগত, জাতীয়তা রক্ষার দায়। দ্বিতীয় কারণ— এলিট-পন্থী না হওয়ার দায়। দ্বিতীয়টার মধ্যে যদি-বা কিছু যুক্তি আছে, প্রথম কারণটা কিন্তু বেলুনের মতো ফাঁপা।

Advertisement

রামমনোহর লোহিয়া ভারতের সমাজতান্ত্রিক নেতাদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়। তিনি এক বার বলেছিলেন, ভারত শাসনের জন্য ব্রিটেন প্রধানত দুটি অস্ত্র ব্যবহার করে গিয়েছে। এক, বুলেট। দুই, ইংরেজি ভাষা। সন্দেহ নেই, লোহিয়াপন্থীদের হাতে দেশের ভাগ্য অর্পিত হলে এত দিনে ইংরেজি নিষিদ্ধ হয়ে যেত। দেশ জুড়ে সবাই হিন্দি বলতে বাধ্য হত।

তেমনটা যে হয়নি, ভেবে আমরা স্বস্তির শ্বাস ফেলতে পারি। লোহিয়া আমাদের নেতা হলে এত সব দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার, অসাধারণ ডাক্তার, কিংবা ক্ষুরধারবুদ্ধি আই-টি বিশেষজ্ঞ, এদের কাউকেই বোধহয় পাওয়া যেত না। অথচ এঁদের কারণে, এঁদের হাতেই তো দেশের এতখানি উন্নতি ঘটেছে! তাঁদের বিদ্যে তো ইংরেজি বই, গবেষণাপত্র, নির্দেশিকা থেকেই আহরণ করা। পুরোটা যদি না-ও হয়, বেশির ভাগটাই তো ইংরেজি-নির্ভর।

লোহিয়া নেই, কিন্তু তাঁর ‘ফ্যাসিবাদী’ মনোভাবটা উত্তর-প্রজন্মের নেতাদের মধ্যে বাহিত হচ্ছে। এই নেতাদের অনেককেই আজকের সমাজবাদী পার্টির শিরোভাগে দেখা যায়। মুলায়ম সিংহ যাদব তাঁদের এক জন। ইনি যে কত গভীর ভাবে ইংরেজিকে ঘৃণা করেন, অনেকেরই সেটা জানা। নিজের রাজনৈতিক কেরিয়ারে আগাগোড়া একনাগাড়ে ইংরেজি-বিতাড়নের চেষ্টা করে এসেছেন এই সমাজবাদী নেতা, উত্তরপ্রদেশের সরকারি কাজকর্মের অঙিনা থেকে ইংরেজিকে নির্বাসন দেওয়ার যাবতীয় চেষ্টা করেছেন। মজার ব্যাপার, তাঁর ছেলে ও রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী, উত্তরপ্রদেশের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী আবার অন্য মানসিকতার। বাবার মতো ইংরেজি-বিদ্বেষ অখিলেশ যাদবের মধ্যে নেই। কিছু দিন আগেই তিনি ঘোষণা করেছেন, তাঁর দল ঠিক ‘ইংরেজির বিরুদ্ধে’ নয়, কিন্তু মানুষকে ‘হিন্দি ব্যবহারে’ উদ্বুদ্ধ করতে আগ্রহী। ইংরেজি-শিক্ষিতদের থেকে হিন্দি-শিক্ষিতরা যেন পিছিয়ে না থাকেন, সেটাই নাকি নিশ্চিত করতে চায় তাঁদের দল।

কথাটা শুনতে বেশ নিরীহ, স্বাভাবিক, বলা চলে। কাজে এই কথা সত্যিই প্রযুক্ত হয় কি না, সেটা আলাদা প্রশ্ন। যাই হোক, এটা ঠিক যে আগেকার সমাজবাদী পার্টির তুলনায় অখিলেশের এই অবস্থান রীতিমত বৈপ্লবিক। পুরনো পার্টিতে ইংরেজির কোনও স্বীকৃতিই ছিল না। এখন তরুণ নেতার নতুন জমানার হালচাল হয়তো সময়ের মাহাত্ম্যেই পাল্টাতে হচ্ছে। অখিলেশ যাদব তাঁর বাবার (কিংবা মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর) তুলনায় আজকের সময়ের সঙ্গে খানিকটা বেশি তাল রেখে চলতে ইচ্ছুক। কিংবা, বাধ্য।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর স্মরণে আছে কি না জানা নেই, তাঁর দলের অন্যতম রোল-মডেল স্বামী বিবেকানন্দ কিন্তু ইংরেজি বিষয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর লোক ছিলেন। শুধু নিজে দারুণ ইংরেজি-বলিয়েই ছিলেন না, ইংরেজি ভাষা ব্যাপক ভাবে ব্যবহারের বিষয়েও তাঁর অত্যন্ত আগ্রহ ছিল। তাঁর অধিকাংশ লেখা ওই ভাষাটিতেই। আজ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়তো বিবেকানন্দকে ধমকে সোজা করে দিতেন: ‘আংরেz!’ বাস্তবিক, আজকের দিনে স্বামীজি থাকলে বেচারাকে বোধহয় সব লেখাই সংস্কৃতে লিখতে হত। আর কথা বলতে হত— হিন্দিতে!

ধরে নেওয়া যেতে পারে, ভারতীয় ইতিহাস বিষয়ে রাজনাথ সিংহের যা কিছু জ্ঞান, পার্টির লিফলেট বা বইপত্র থেকেই সে সব আহরিত হয়েছে। তাই কতগুলো গোড়ার জরুরি তথ্য তাঁর জেনে ওঠা হয়নি। ইংরেজ শাসনকালে ইংরেজি ভাষাটাকে কিন্তু ভারতীয়দের উপর ঠিক চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। ‘নেটিভ’-রা নিজেরাই উৎসাহ ও আগ্রহ সহকারে ইংরেজি জানতে-শিখতে শুরু করেছিলেন। ইতিহাসবিদ রমেশ মজুমদারের প্রবন্ধ ‘ইংলিশ এডুকেশন’ জানাচ্ছে, ইংরেজি প্রচারের বিষয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নীতি প্রবর্তনের আগেই কলকাতার বাঙালি হিন্দু সমাজ প্রথম ইংরেজি শিক্ষার প্রতিষ্ঠানটি তৈরি করে ফেলেছিল। তাঁর মতে, ‘‘সাধারণ ভাবে মনে করা হয়, ব্রিটিশরা এ দেশে ইংরেজি শিক্ষা ছড়ানোর চেষ্টা শুরু করে কেরানি তৈরির কল হিসেবে। এর থেকে বড় ভুল আর হতে পারে না। ব্রিটিশ সরকার এ দেশে ইংরেজি চালু করেনি, বরং প্রথম দিকে তাদের অনুৎসাহ সত্ত্বেও ইংরেজিশিক্ষার প্রচলন হয়। গোড়ায় ব্রিটিশ সরকার এর বিরুদ্ধে ছিল। পরে তাদের মনোভাব পাল্টায়। ১৮৩৫ সাল অবধি ভারতে ইংরেজি শিক্ষা প্রসারের তেমন কোনও সংগঠিত প্রয়াস ব্রিটিশরা করেনি।’’

ইংরেজদের সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের গুরুস্থানীয় টমাস ব্যাবিংটন মেকলে আশা করেছিলেন, ইংরেজি শিক্ষার ফলে এ দেশে একটি অনুগত শ্রেণি তৈরি হবে। ইতিহাস প্রমাণ করেছে, তাঁর ভাবনা ভুল ছিল। বরং, ইংরেজি শিক্ষার যত প্রসার হয়েছে, সাম্য ও মুক্তির ধারণা ততই ছড়িয়েছে, জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটেছে, আর শেষ পর্যন্ত দেশের স্বাধীনতার দাবি উঠেছে। আর আজ? সাম্রাজ্যবাদ-উত্তর, উত্তর-আধুনিক একুশ শতকের নানা সমীক্ষায় স্পষ্ট ধরা পড়ছে— সময়ের সঙ্গে এ দেশের শিক্ষিত সমাজ আরও বেশি করে বেসরকারি শিক্ষা অর্থাৎ ইংরেজি-অধ্যুষিত শিক্ষার দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। মধ্যবিত্ত ও সম্পন্ন ভারতীয়ের কাছে দেশীয় ভাষা-নির্ভর সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা দ্রুত অবাঞ্ছিত হয়ে পড়ছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ইংরেজি-মাধ্যম স্কুলগুলিতে ২০০৩ ও ২০০৬ সালের মধ্যে পড়ুয়া-সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৭৪ শতাংশ। মধ্যবিত্তের সংখ্যাবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ইংরেজি-পড়ুয়ার সংখ্যা। এত সংখ্যক অল্পবয়সি ভারতীয়রা ইংরেজি শিখতে চাইছে কিন্তু ‘আংরেz’ হওয়ার জন্য নয়। তারা জানে, আজকের দুনিয়ায় সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ ইংরেজিই দেখাতে পারে।

এটা কেবল ভারতের বাস্তব নয়। চিন, ইউরোপ, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকার অগণিত মানুষ এই রকমই ভাবছেন। সে সব দেশেও ইংরেজির প্রচলন বাড়ছে। ইংরেজি আসলে আমাদের সময়ের আন্তর্জাতিক ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভবিষ্যৎ যতটা দেখা সম্ভব, মনে হয়, পরিস্থিতি আপাতত এমনই থাকবে।

আমাদের নেতারাও খুব ভাল করে সেটা জানেন। তবু তরুণ প্রজন্মকে তাঁরা ইংরেজি শিখতে উৎসাহ দিতে রাজি নন। দুনিয়ার অন্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভারতকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভাবনা ভাবতে রাজি নন। স্বল্পমেয়াদি রাজনীতির ঘোরে তাঁরা আচ্ছন্ন। তাই এখনও তাঁরা অতীতের কাসুন্দি নিয়েই চিন্তিত। নিজেদের ইংরেজিজ্ঞানের অভাবটাকে সনাতন ভারতীয়ত্বের আদর্শের মোড়ে চাপাচুপি দিয়ে রাখতে ব্যস্ত।

ভারতের যা কিছু ঐতিহ্য, কৃতিত্ব — সে সব এই সব অর্ধশিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত মানুষের বস্তাপচা সংকীর্ণতা থেকে তৈরি হয়নি। ভারতের সেই নিজস্বতা উৎসারিত হয়েছে প্রাচীন মুনি-ঋষি আর আধুনিক চিন্তাবিদদের মননশীলতা থেকে। তাঁরা সকলেই একটা জিনিস আমাদের শেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। সহনশীলতা আর গ্রহণশীলতার মূল্য।

‘এজ অব অ্যাংজাইটি’ বইয়ের লেখক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন