যুদ্ধ-উত্তেজনা প্রশমনের ইঙ্গিতমাত্রই যে কত বড় মঙ্গলসংবাদ, বৃহস্পতিবার হইতে ভারতীয় উপমহাদেশ তাহা অনুভব করিতেছে। দীর্ঘকালীন শান্তির আশা এখনও বাতুলতা, এই প্রশমন কতখানি স্থায়ী হইবে, তাহাও বলা দুরূহ। তবে এইটুকু ধরিয়া লওয়া যায় যে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ভারত পাকিস্তান সম্পর্কের পারদ যে বিন্দুতে উঠিয়াছিল, আপাতত তাহা সে বিন্দু হইতে নামিয়া আসিতেছে। পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ঘোষণা: ‘শান্তির লক্ষ্য’-এ পাক বাহিনীর হাতে বন্দি ভারতীয় উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানকে মুক্তি দেওয়া হইতেছে— এক অর্থে অপ্রত্যাশিত। এবং অপ্রত্যাশিত বলিয়াই বিশেষ সন্তোষজনক। গত এক পক্ষকাল যাবৎ দুই দেশের সম্পর্ক কেবল উপমহাদেশকে নহে, সমগ্র বিশ্বকে প্রবল উৎকণ্ঠায় রাখিয়াছিল। বাস্তবিক, দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের সংঘর্ষ গত শতাব্দীর মধ্যভাগ হইতে অহরহ বহমান থাকিলেও ১৯৭১ সালের পর যুদ্ধের এতখানি নিকটে তাহারা আর কখনও আসে নাই। দুই দেশের ক্ষীণদৃষ্টি অর্বাচীন যুদ্ধবাজরা যুদ্ধ-যুদ্ধ বলিয়া লাফাইতেছিলেন, সরকারকে উগ্রতর জাতীয়তাবাদের দিকে ঠেলিতেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শুভবুদ্ধির জয় ঘটিয়াছে। শান্তির আশা না থাকিলেও যুদ্ধের আশঙ্কামেঘ কাটিতেছে। উলুখাগড়াগণ হাঁপ ছাড়িতেছেন। বিশেষত কাশ্মীরের উলুখাগড়াগণ— কেননা দুই দেশের ইগো-সংঘর্ষে তাঁহারাই সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান বলিপ্রদত্ত। তাঁহাদের ক্ষণিক স্বস্তিবোধও সামান্য ঘটনা নয়।
শান্তি প্রস্তাবটি যে হেতু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দিক হইতে আসিয়াছে, এই অবকাশে বলিতেই হয় যে এমন প্রচেষ্টা খুব সুলভ নহে। আগে বহু বার দেখা গিয়াছে, অকারণ মানস-প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হইয়া ইসলামাবাদ উত্তেজনার পারদ বেশ কয়েক দাগ চড়াইয়া দিয়াছে। পাকিস্তানে ভারতীয় বন্দিদের সহিত দুর্ব্যবহারের নজিরও কম নহে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে দেখিলে নূতন প্রধানমন্ত্রীর এই পদক্ষেপ অতীব স্বস্তিদায়ক। তবে কিনা, ‘শান্তির লক্ষ্য’ তাঁহাকে কত দূর লইয়া যাইতে পারে, সে বিষয়ে বাজি ধরা মুশকিল। তিনি যদি একই সক্রিয়তার সহিত সন্ত্রাস-সঙ্কটের দিকে মন দেন, ভারত কেন, গোটা বিশ্বদুনিয়াই তাঁহার নিকট কৃতজ্ঞ থাকিবে। কাশ্মীর উপত্যকায় সন্ত্রাসগোষ্ঠীর কার্যক্রমে উৎসাহদানের মাধ্যমে ভারতের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধ চালাইয়া যাওয়ার প্রবণতা হইতে যদি তিনি পাক রাষ্ট্র ও সামরিক সংগঠনকে নিরত করিতে পারেন, তবে এই শতকের অন্যতম শান্তিদূত হিসাবে তিনি গণ্য হইবেন। কিন্তু শান্তিতে অতখানি বিশ্বাস তিনি রাখিবেন কি?
রাষ্ট্রের ভূমিকার পাশাপাশি বলা দরকার সমাজের ভূমিকার কথাও। গত কয়েক দিনে, পাকিস্তানের প্রধান নগরগুলিতে নাগরিক সমাজের যে স্বতোৎসারিত শান্তিমিছিল এবং শান্তির স্লোগান দেখা গিয়াছে, তাহাকে ঐতিহাসিক বলিলে অতিরঞ্জন হয় না। শান্তির প্রয়োজনটি যে পাক নাগরিকবর্গ, বিশেষত সে দেশের মহিলারাও, এই ভাবে পথে নামিয়া ঘোষণা করিতেছেন, তাহা দেখিয়া নূতন সূর্যোদয়ের আশা করিতে ইচ্ছা হয়। সাংবাদিকরা সে দেশে যে ভাবে শান্তির দাবি উঠাইয়াছেন, তাহা কোথাও পাক রাষ্ট্রশক্তিকেও প্রভাবিত করিয়াছে, বিশ্বাস করিতে ইচ্ছা হয়। ভারতের কথাও এই প্রসঙ্গে আসিবে। বিজেপি সরকারের চরম পাকিস্তানবিরোধিতা এবং তাহার সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ অতিজাতীয়তাবাদী সামাজিক বিকারের পাশেও কিন্তু ভারতীয় নাগরিক সমাজের একাংশের শান্তিকামনা স্পষ্টত শ্রুত হইয়াছে। দুই দেশের যে নাগরিকরা এই সঙ্কটমুহূর্তেও ধৈর্য রাখিয়া তাঁহাদের নিজ নিজ রাষ্ট্রকে শান্তির পথে হাঁটিতে অনুরোধ জানাইয়াছেন, তাঁহাদের দেখিয়া আশা হয় যে, কোনও এক অনাগত ভবিষ্যতে ভারত পাকিস্তানের মতো অভিশপ্ত সম্পর্কেও শান্তির প্রলেপ পড়া অসম্ভব নয়।