যাহা যায় তাহা যায়

সম্প্রতি জানা গেল, পৃথিবীর বুক হইতে ১০ লক্ষ প্রজাতি— মোট প্রজাতির আট ভাগের এক ভাগ— বিলুপ্ত হইবার মুখে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৯ ০০:২৬
Share:

চিনের একটি টায়ার উৎপাদন কেন্দ্র। ছবি: রয়টার্স।

শিল্পবিপ্লবের মুহূর্তটি মানবসভ্যতার ইতিহাসে নির্বিকল্প। সেই মুহূর্ত হইতেই মানুষের ভাল থাকিবার সূচনা— প্রত্যাশিত গড় আয়ু হইতে পুষ্টির মাপ, আয়ের অঙ্ক হইতে ভোগের পরিমাণ, শিল্পবিপ্লবের মাইলফলকটি পার করিয়া প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানুষ অভূতপূর্ব উন্নতি করিয়াছে। বহু দিন অবধি সেই উন্নতির খবরই জানা ছিল। বিগত কয়েক দশকে বিজ্ঞানীরা জানাইয়াছেন, সেই আলোর বিপ্রতীপে বিপুল অন্ধকারও রহিয়াছে। দূষণ হইতে উষ্ণায়ন, প্রতিটি বিপদের সূত্রপাতও শিল্পবিপ্লবের মাইলফলক ছুঁইয়াছে। সম্প্রতি জানা গেল, পৃথিবীর বুক হইতে ১০ লক্ষ প্রজাতি— মোট প্রজাতির আট ভাগের এক ভাগ— বিলুপ্ত হইবার মুখে। এবং, সেই অঘটনের মূলেও শিল্পবিপ্লব। সমাপতন নহে, তাহা বলা বাহুল্য। কেন শিল্পবিপ্লবেই সমস্যাগুলির শিকড়, তাহা বোঝাও দুষ্কর নহে— ইতিহাসের সেই মুহূর্তটি হইতেই উৎপাদনের প্রক্রিয়া বদলাইয়া গিয়াছিল। পুঁজির ব্যবহারে, যন্ত্রের আনুকূল্যে উৎপাদন আর মানবিক শ্রমের সীমায় সীমিত থাকে নাই। পূর্বে এক জন মানুষের পক্ষে যতখানি প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করা সম্ভব ছিল, যন্ত্র ক্রমে সেই পরিমাণকে বহু বহু গুণ বাড়াইয়া লইয়া গিয়াছে। মানুষ শুধুই লইয়াছে, ফিরাইয়া দেয় নাই। কথাটি বুঝিতে বিজ্ঞানী হইবারও প্রয়োজন নাই। প্রায় এক শতক পূর্বে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ফিরাইয়া দেওয়ার গুরুত্ব স্মরণ করাইয়া দিয়াছিলেন।
মানুষ ফিরাইতে শিখে নাই। তাহার পরিণতি অনিবার্য— জীববৈচিত্র ধ্বংস হইতেছে, পরিবেশ বিরূপ, কয়েকশত কোটি মানুষের জীবন বিপন্ন।

Advertisement

শিল্পবিপ্লবসঞ্জাত সভ্যতার অভিজ্ঞান ভোগবাদ। মানুষ সুখ খুঁজিয়াছে। পণ্যে, উপভোগে। প্রকৃতি হইতে বিযুক্ত হইবার প্রক্রিয়াটি এত গভীরে পৌঁছাইয়াছে যে বর্তমান বিপদটিরও যথেষ্ট অনুরণন বহু মানুষের মনেই ঘটে নাই বলিয়া সন্দেহ। মানুষ আরও ভোগ চাহিয়াছে। বাজার সেই চাহিদা মিটাইয়াছে প্রাণপণ। বাজার চাহিদা-জোগানের সমীকরণ বোঝে। লাভ-ক্ষতির অঙ্কেই তাহার শ্বাসবায়ু। কোথায় কোন প্রজাতি বিপন্ন হইতেছে, সমুদ্রের জলতল ক্রমেই বাড়িয়া চলিতেছে কি না, ঝড়ের সংখ্যা ও তীব্রতা বাড়িতেছে কি না, বাজার সেই হিসাব রাখে না। তাহার প্রক্রিয়াটিই এমন যে সেই হিসাব রাখিবার অবকাশ নাই। বাজারের এই সমস্যাটি নূতন নহে। হেনরি সিজউইক এবং আর্থার পিগু, এক্সটার্নালিটি বা অতিক্রিয়ার আদি প্রবক্তাদের উভয়েই শতকাধিক প্রাচীন। অর্থনীতির তত্ত্বে এই অতিক্রিয়ার সমাধানও আছে— বাজারকে রাষ্ট্র এই অতিক্রিয়ার অর্থনৈতিক ব্যয় বহন করিতে বাধ্য করিবে। কার্বন কর সেই দর্শনের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

তবে, অভিজ্ঞতা শিখাইয়াছে, বাজার আর রাষ্ট্রকে পৃথক করা দুষ্কর। রাষ্ট্রীয় শীর্ষাসনে অধিষ্ঠিতরা এমন ভাবে বাজারের স্বার্থের বশীভূত অথবা তাহার সহিত একাত্ম হইয়া পড়েন যে নিয়ন্ত্রণের প্রত্যাশা বাতুলতা হইয়া দাঁড়ায়। উদাহরণ খুঁজিলে মার্কিন মুলুকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথা আসিবে, অথবা নিকটতর নরেন্দ্র মোদীর। আন্তর্জাতিক কোনও প্রতিষ্ঠান? তাহাও কি দেশের ভৌগোলিক পরিসীমার বাণিজ্য-রাজনীতি সংগঠনের বাহিরে থাকে? থাকা সম্ভব? পড়িয়া থাকে নব্যউদারবাদ। যে দর্শন বলিবে, কোনও নিয়ন্ত্রণেরই প্রয়োজন নাই, বাজার নিজের তাগিদেই আজ না হউক পরশুর পরের দিন সব ঠিক করিয়া লইবে। এই কথাটির বৃহত্তর যৌক্তিকতা আপাতত তর্কের বাহিরে থাকুক। কিন্তু, পুঁজির চলনের বাহিরে থাকে যে পরিসর— যেখানে প্রান্তিক মানুষের বাস, যেখানে জীববৈচিত্রের অধিষ্ঠান— সেই পরিসরটির কথা পুঁজি ভাবিতে পারে না। ভাবিবার দায়িত্ব কাহার, তাহাই এই মুহূর্তে বৃহত্তম প্রশ্ন। অতি দ্রুত উত্তর না মিলিলে, আশঙ্কা হয়, উত্তর খুঁজিবার জন্য যথেষ্ট সময় বাঁচিয়া থাকিবে না।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন