International Mother Language Day

বাংলিশ নয়, যথার্থ বাংলা ভাষার প্রয়োগেই ভাষাদিবসের সার্থকতা

মাতৃভাষা দিবস উদ্‌যাপন অবশ্যই জরুরি। তবে, একই সঙ্গে জরুরি সারা বছর মাতৃভাষাকে সম্মান করা। বর্তমান পৃথিবীর প্রায় ২৬ কোটি মানুষ কথা বলেন বাংলায়। তার ভিত্তিতেই এই ভাষার স্থান বিশ্বে সপ্তম।

Advertisement

শঙ্খনাদ আচার্য

শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৪:১৮
Share:

মহা আড়ম্বরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্‌যাপন দেখে প্রশ্ন জাগে, বঙ্গসমাজ কি আদৌ বিশ্বাস করে রবীন্দ্রনাথের সেই উক্তি— মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ? শুধু প্রশ্ন নয়, পীড়াও দেয় বাংলা ভাষার গতি বর্তমান বাঙালি সমাজের অবহেলার ছবি দেখে। আধুনিক বঙ্গবাসী বাংলা বলেন না তা নয়। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে তাঁদের মুখে যে বাংলা শোনা যায়, তাকে ‘বাংলিশ’ বললে অত্যুক্তি হয় না! মানে, বাংলা আর ইংরিজী মিশিয়ে বলা কথা। এ বড় আক্ষেপের বিষয়। বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে যে রক্তস্নাত আন্দোলনের ফলশ্রুতি হলো "আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস" সেই বাংলা ভাষাই ক্রমশ তার নিজস্বতা হারিয়ে ফেলছে।

Advertisement

বর্তমান পৃথিবীর প্রায় ২৬ কোটি মানুষ কথা বলেন বাংলায়। তার ভিত্তিতেই এই ভাষার স্থান বিশ্বে সপ্তম। আমাদের দেশে কথ্য ভাষার বিচারে হিন্দির পরেই স্থান (প্রায় ১০ কোটি) আমাদের মাতৃভাষার। সেই বাংলা ভাষার লালিত্য কি বাঙালি অটুট রাখতে পেরেছে? মনে হয় না। কারণ, কথ্য ভাষার নিরিখে ভারতে দ্বিতীয় এই ঐতিহ্যশালী বাংলা ভাষায় কথা বলতে গিয়ে বর্তমানে অধিকাংশ বাঙালি প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ইংরেজি-হিন্দি শব্দের মিশ্রণ ঘটান। এঁদের মধ্যে আবার কিছু কেতাদুরস্ত বাঙালিও রয়েছেন। তাঁরা ভাবেন, যদি নিজেদের মধ্যে ইংরেজিতে কথোপকথনে লিপ্ত হতে পারেন, তবে তার চেয়ে আভিজাত্যের বিষয় আর কিছু হতে পারে না।

ইংরেজি বর্ণমালায় যে ২৬টি বর্ণ রয়েছে, তা অবলীলায় তাঁরা বলে দিতে পারেন। কিন্তু মাতৃভাষায় কতগুলো বর্ণ রয়েছে, তার উত্তর দিতে গিয়ে অনেকেরই গলা শুকিয়ে আসতে পারে। মাতৃভাষার সঙ্গে ইংরেজি-হিন্দির অদ্ভুত মিশ্রণ ঘটিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করার ক্ষেত্রে তাঁদের জুড়ি মেলা ভার।

Advertisement

এ কথা সত্য যে, বাংলা ভাষায় অজস্র বিদেশি শব্দ স্থান পিয়েছে। কিন্তু বর্তমানে আমরা বিভিন্ন নতুন শব্দের, বিশেষত ইংরেজি ও হিন্দি শব্দের সঙ্গে বাংলা ভাষার অপরিকল্পিত মিশ্রণ ঘটাচ্ছি, যা কথ্য বাংলার ক্ষেত্রে বিপজ্জনক। বাড়িতে-বাইরে সারাদিনে কথা বলতে গিয়ে আমরা যে প্রয়োজন ছাড়াই কতগুলি ইংরেজি বা হিন্দি শব্দের ব্যবহার করে ফেলছি, আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি? তাই প্রশ্ন জাগে, ‘সরি’ বললে কি ‘দুঃখিত’র চেয়ে বেশি দুঃখ প্রকাশ করা হয়? না কি ‘থ্যাঙ্কস’ বললে ‘ধন্যবাদ’ বলার চেয়ে বেশি সাধুবাদ দেওয়া হয়? বাংলা প্রতিশব্দ থাকা সত্ত্বেও আমরা ইংরেজি শব্দ স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করে আনন্দ পাচ্ছি। শুধু তাই নয়, ‘পাপা’, ‘মম’, ‘বেটা’ এখন বাঙালির অনায়াস অভিব্যক্তি! তথাকথিত শিক্ষিত বাঙালি সমাজ আজ বন্ধুকে ‘ফ্রেন্ড’, আত্মীয়কে ‘রিলেটিভ’, মাছের ঝোলকে ‘ফিশ কারি’, পাঁঠার মাংসকে ‘মাটন’, বাজারকে ‘মার্কেট’, মামা-কাকাকে ‘আঙ্কল’ বলতে এবং মাসি- পিসি-কাকিমা-জেঠিমাকে ‘আন্টি’ বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এই তালিকা ক্রমবর্ধমান, যেগুলো বর্জন করার সদিচ্ছাও চোখে পড়ে না!

মনে হতে পারে, তা হলে কি বাঙালি চিরকাল বাংলা ভাষাতেই আবদ্ধ থাকবে? যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবে না? বাঙালি কি ‘স্মার্ট’ হবে না? বাঙালির জীবনে কি বিশ্বায়নের প্রভাব আসবে না? বঙ্গসন্তান ইংরেজিমাধ্যম বিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করবে না? বহুজাতিক সংস্থার বিপণিতে যাবে না? ইন্টারনেট ব্যবহার করবে না? অবশ্যই করবে। সব কিছুই করবে। কিন্তু মাতৃভাষাকে উপেক্ষা না করেও এই সমস্ত কাজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখা যায়। কারণ, নিজের মাতৃভাষাকে বিকৃত করে আর যাই হোক ‘স্মার্ট’ হওয়া যায় না। বলছি না যে, বাংলা ভাষায় কথা বলতে গিয়ে মোবাইলকে ‘চলভাষ’, চেয়ারকে ‘কেদারা’ বা ইন্টারনেটকে ‘আন্তর্জাল’ বলা জরুরি। কারণ, তাতে ভাষা ব্যবহারের মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে। তবে এটাও ভাবার বিষয় যে, মাতৃভাষার বিকৃত প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে। তাই সন্তান ইংরেজিমাধ্যম বিদ্যালয়ে পড়লেও আদব-কায়দার সংস্কৃতি বাড়িতে পরিবারের হাতে ঠিকভাবে পাবে, এটাই কাম্য। আরেকটা বিষয়ে আমরা খুব ভাল করেই অবগত যে, আমরা বাংলা বলতে গিয়ে ইংরেজি বা হিন্দি ব্যবহার করে ফেলি ঠিকই, কিন্তু ইংরেজিতে কথা বলতে গিয়ে আমরা বাংলা বা হিন্দি কোনওটাই ব্যবহার করি না। তাই আমাদের মনে রাখতে হবে, যখন আমরা আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলব, তখন যথাসম্ভব বাংলা শব্দ ব্যবহারের চেষ্টাই করব। আর অবশ্যই আমাদের রাজ্যে যে কোনও প্রান্তের ঝাঁ-চকচকে রেস্তরাঁ বা বহুজাতিক সংস্থার বিপণিতে আমরা বাংলা ভাষারই প্রয়োগ করব। তাতে আমাদের জাত্যাভিমানে বিন্দুমাত্র আঘাত লাগার কোনও সম্ভাবনা নেই। রাশিয়া, চিন, জাপান প্রভৃতি দেশগুলি মাতৃভাষায় ব্যবহার করে যদি সব দিক থেকে উন্নতি করতে পারে, তবে বাঙালি পারবে না কেন? বাংলা ভাষায় কথা বলতে গিয়ে আমরা যদি এখনই ভাষার বিকৃত প্রয়োগ বন্ধ না করি, তা হলে সেদিন আর খুব দূরে নেই, যেদিন ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের ছড়ার বাস্তবায়ন ঘটবে। সেই মায়ের কথা দিয়ে যিনি তাঁর পুত্র সম্পর্কে সগৌরব বলবেন— ‘ছেলে আমার খুব সিরিয়াস কথায় কথায় হাসে না/জানেন দাদা আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না’!

(লেখক দিনহাটার গোপালনগর এমএসএস হাইস্কুলের শিক্ষক। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন