হ্যাঁ: গণভোটের ফল জানার পরে গর্ভপাতের অধিকারের সমর্থকরা। ডাবলিন, ২৬ মে। ছবি: রয়টার্স
কিছু কিছু মুহূর্তের জন্ম হয়, যখন সভ্যতার প্রতি, মানবতার প্রতি বিশ্বাস, শুভবুদ্ধির প্রতি আস্থা বড় কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়ে। চার পাশে এমন সব ঘটনা মুহুর্মুহু ঘটে যেতে থাকে, মনে হয়, এ কালরাত্রির যেন বা শেষ নেই। একটি-দু’টি আলোকবিন্দুর তখন একান্ত প্রয়োজন, যাতে ধুনিটুকু জ্বালিয়ে রাখা যায়। হাওড়া-মালদহ ফাস্ট প্যাসেঞ্জারের কামরা থেকে কোনও মতে মুখ বাড়িয়ে তাই চেয়ে থাকা আয়ারল্যান্ডের দিকে।
কালিয়াচকের জামাল মোমিনের কাছে আয়ারল্যান্ডের কোনও অস্তিত্ব সম্ভবত নেই। জামাল মোমিনকে মারতে মারতে ভারতমাতার জয়গান করাচ্ছিলেন যাঁরা, তাঁরা হয়তো আয়ারল্যান্ডের খবর কাগজে পড়ে থাকবেন। তবে গণভোটে গর্ভপাতের অধিকারের পক্ষে মত দেওয়াটা সে দেশের নিরিখে কতখানি বৈপ্লবিক, সেটা তলিয়ে ভাবার সাধ সম্ভবত তাঁদের হয়নি। ভাবলে কিন্তু অস্বস্তিতে পড়তে হবে। কারণ, আয়ারল্যান্ডের এই ভোট শুধু একটা আইনি কচকচি নয়, এই ভোট পরাক্রমী ক্যাথলিক চার্চের প্রতিস্পর্ধী অবস্থানকে জানান দেওয়ার ভোট।
আমাদের দেশে এই মুহূর্তে প্রতিস্পর্ধার পরিসরটি অতীব সঙ্কুচিত। তবে সত্যিকারের দুশ্চিন্তার জায়গাটা সেটুকুই নয়। বিতর্কের, বিরোধিতার, প্রশ্ন তোলার অধিকার ক্রমশ খর্ব হচ্ছে, সেটা একটা কথা। কিন্তু দেশবাসীর একটা বৃহৎ অংশ যে তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে উন্মত্ত উল্লাসে উদ্বাহু, বৃহত্তর বিপদটা সেইখানে। জামাল মোমিনের নিগ্রহ আবার তার থেকেও বেশি আতঙ্কের, কারণ সেখানে প্রতিস্পর্ধার লেশমাত্র ছিল না। জামাল কোনও কূট তর্ক করতে গিয়ে নিগৃহীত হননি। স্রেফ এমনি এমনি কিছু মানুষ হাসতে হাসতে রগুড়ে মেজাজে তাঁর গায়ে হাত তুলল, মানুষ হিসেবে তাঁর প্রাপ্য ন্যূনতম মর্যাদাটুকু মাটিতে মিশিয়ে ভারী আমোদ পেল। নিজের সভ্যতার ইতিহাস নিয়ে গর্ব করা একটা দেশ, নিজের শিল্প-সংস্কৃতির উত্তরাধিকার নিয়ে বড়াই করা একটা রাজ্য যখন এই বীভৎস মজায় খিলখিলিয়ে ওঠে, তখন শাশ্বত সুচেতনায় ভরসা বাঁচিয়ে রাখা এক রকম অসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়।
এই বিক্ষত মন তার পরে যখন আয়ারল্যান্ডকে ‘হ্যাঁ’ বলতে শোনে, তলিয়ে যেতে যেতেও একটু থমকায়। হাওড়ার ট্রেন থেকে ডাবলিনের রাস্তা, কোথাও একটা অব্যক্ত সংলাপ রচিত হয়। ধ্বস্ত বিশ্বাস আর দূরাগত আশ্বাসের সংলাপ। এ কথা বলা মানে, আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে ভারতকে দাঁড়িপাল্লায় বসিয়ে দেওয়া নয়। কোনও মডেল খাড়া করতে চাওয়াও নয়। ইতিহাস, ভূগোল, ধর্ম ও সংস্কৃতি, রাজনীতি, জনসংখ্যা, আর্থিক বিকাশ এবং সর্বোপরি নাগরিকদের মধ্যে আর্থসামাজিক বৈষম্য ও বিভাজনে ভারতের চালচিত্রটি আয়ারল্যান্ডের চেয়ে বহু গুণে জটিল। কিন্তু আয়ারল্যান্ডের পক্ষে এই ‘হ্যাঁ’ বলাটা যে কতখানি পরিবর্তন আর সামাজিক উতরোলের বার্তাবাহী, সেটা মনে রাখলে নাগরিক সমাজের আত্মশক্তিতে নতুন করে আস্থা জাগে বইকি! দুটো দেশের নাগরিক সমাজের মধ্যে অনেক ফারাক থাকতেই পারে, কিন্তু নাগরিক সমাজের কার্যকারিতার ধারণাটিই যে দেউলিয়া হয়ে যায়নি, সেটা মনে রাখতেও কিছু অনুপান লাগে। আয়ারল্যান্ড এই মুহূর্তের সেই অনুপান।
পঞ্চম শতাব্দী থেকে আয়ারল্যান্ডে ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাসের ভিতটি পোক্ত। ষোড়শ শতক থেকে টিউডর ইংল্যান্ড যখন আয়ারল্যান্ডকে নিজের কব্জায় আনা শুরু করে, সেই তখন থেকে শুরু করে বিশ শতকে স্বাধীন আয়ারল্যান্ড গঠন ইস্তক তার স্বাধিকারের দাবির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে ক্যাথলিক সত্তার নির্ঘোষ। ইংল্যান্ডের প্রোটেস্টান্ট রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াইয়ে ক্যাথলিক ধর্ম বরাবরই আয়ারল্যান্ডের অস্মিতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে থেকেছে। ১৯২২ সালে ফ্রি স্টেট অব আয়ারল্যান্ড গঠন, ১৯৩৭-এ নতুন সংবিধান প্রণয়ন এবং ১৯৪৯-এ আইরিশ প্রজাতন্ত্রের ঘোষণা। কিন্তু চার্চ আর সরকারের পারস্পরিক সম্পর্ক কার্যত জড়িয়ে ছিল ঘোড়া আর গাড়ির মতোই। ২০১২ সালেও তাই হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে সবিতা হলপ্পনবার যখন বার বার ডাক্তারদের বলেছেন গর্ভপাতের জন্য, তাঁকে শুনতে হয়েছে ‘নিয়ম নেই’।
আয়ারল্যান্ডের প্রজাতন্ত্রী আইনের টিকি আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা ক্যাথলিক অনুশাসনে। সময়ের সঙ্গে বেড়ি আলগা হওয়ার বদলে আরও যেন চেপে বসেছে। নইলে ১৮৬১ সালের যে আইনে গর্ভপাত নিষিদ্ধ ছিল, সে আইন ১৯৬৭ সালেই বাতিল হয়ে গিয়েছে ইংল্যান্ডে। ক্যাথলিকতার দোহাই দিয়ে আয়ারল্যান্ড কিন্তু সে পথে হাঁটেনি। শুধু তা-ই নয়, ১৯৩৭-এর সংবিধানে এই নিষেধাজ্ঞাটা যথেষ্ট দেগে দেওয়া হয়নি বলে ১৯৮৩ সালে সংবিধানে সংশোধনী এনেছিল।
প্রথম ধাক্কাটা আসে ১৯৯২-তে। চোদ্দো বছরের এক কিশোরী ধর্ষণের পরিণামে অন্তঃসত্ত্বা। বাবা-মা আদালতে মেয়ের গর্ভপাতের অনুমতি চাইলেন। হাইকোর্ট নিষেধাজ্ঞা দিল। কিশোরীটি তখন আত্মহত্যায় উদ্যত। সুপ্রিম কোর্ট বলল, আয়ারল্যান্ডের বাইরে গিয়ে গর্ভপাত করানো যাবে। ঐতিহাসিক রায়। প্রচুর তর্কবিতর্ক হল। তথাকথিত ‘জীবনমুখী’রা সুর চড়ালেন। বললেন, ভ্রূণের বাঁচার অধিকার কম কিসে? বস্তুত এই তর্ক আজও ফুরোয়নি। আমেরিকায় ও ব্রিটেনে রাজনীতিকদের একটা অংশ দীর্ঘ দিন ধরে এই নিয়ে গলা ফাটাচ্ছেন। তাঁরা ভ্রূণের জীবনের অধিকার নিয়ে যতটা চিন্তিত, মায়ের জীবনের অধিকার, মাতৃত্বকে বেছে নেওয়া এবং না নেওয়ার অধিকার নিয়ে ততটা নন। এক অনাগত জীবনের মুখ চেয়ে জীবিতের কণ্ঠরোধে তাঁদের আপত্তি নেই। আয়ারল্যান্ডের লেবার নেতা কনর ক্রুজ় ও’ব্রায়েন সেই ’৯২তেই চার্চের উদ্দেশে খোলা চিঠি লিখে বলেছিলেন, ‘‘আপনারাই এঁদের আসল মদতদাতা! এই আইনের নৈতিকতার জবাবদিহি আপনাদেরই করতে হবে!’’
১৯৯২ থেকে ২০১২। আরও কুড়ি বছর লাগল পরের ধাক্কাটা আসতে। সুপ্রিম কোর্টের সেই রায় এই দু’দশকেও আইনে পরিণত হয়নি। ভারতের মেয়ে সবিতা নিজে ডাক্তার। ১৭ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ভ্রূণটি নষ্ট হয়ে যেতে বসল। গর্ভপাত না করালে সবিতারও প্রাণসংশয়। ভ্রূণের হৃদস্পন্দন থামেনি, এই যুক্তি আর তার সঙ্গে নিয়মের গেরো দেখিয়ে হাসপাতাল হাত গুটিয়ে বসে রইল। কার্যত সবার চোখের সামনে সবিতা তিল তিল করে মারা গেলেন। সবিতার বেলগাঁও-নিবাসী বাবা-মা তখনই ঠিক করে নিয়েছিলেন, আর চুপ করে থাকা নয়। এই ছ’বছরে সবিতার পরিবারের কণ্ঠ আয়ারল্যান্ডের সিংহভাগ মানুষের কণ্ঠে পরিণত হয়েছে। বস্তুত সবিতা এই আন্দোলনের অন্যতম অনুঘটক। তাঁর মৃত্যুর এক বছরের মধ্যে আয়ারল্যান্ডের ১২টি সংগঠন ১৯৮৩-র সংশোধনী বাতিলের দাবিতে একজোট হয়। রক্ষণশীল শিবিরের জনসংযোগ এবং প্রচার পরিকাঠামো আগে থেকেই মজবুত ছিল। এই নতুন বিতর্কের আবহে তারাও কোমর বাঁধে।
আয়ারল্যান্ডবাসীদের কাছে গণভোট নতুন কিছু নয়। ১৯৮৩-তেও গণভোটই হয়েছিল। কিন্তু সে বারের চেয়ে এ বারের ভোটের বড় তফাত ধরা পড়েছে মেজাজে। এ বারে যুক্তির লড়াই হয়েছে বেশি, মানুষের জীবন থেকে উঠে আসা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো হয়েছে প্রচারে। সেই সঙ্গে বামমনস্ক রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন গণভোটের দাবিকে বাস্তবায়িত করতে সাহায্য করেছে আর নতুন প্রজন্মের স্বতঃস্ফূর্ত চিন্তার জোয়ার সেই ভোটে হ্যাঁ-এর পক্ষে গিয়েছে। ‘হ্যাঁ’-পন্থীরা খুব নির্দিষ্ট বক্তব্য নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন। ভাসা ভাসা আবেগের কথা নয়, মহৎ আদর্শের সাজানো বুলি নয়। বরং কী চাওয়া হচ্ছে, কেন চাওয়া হচ্ছে, কী তার সুবিধার দিক, এগুলো খুব স্পষ্ট করে মানুষকে বলা। গর্ভপাতের পিল নিয়ে কথা বলা। মায়ের জীবনসংশয় দেখা দিলে গর্ভপাত করানো যাবে, এ কথা সবিতার মৃত্যুর পরে সরকারও মেনে নিয়েছিল। হ্যাঁ-পন্থীরা চোখে আঙুল দিয়ে বোঝালেন, এটা যথেষ্ট নয়। গর্ভাবস্থার বারো সপ্তাহ পর্যন্ত গর্ভপাতের অধিকারকে সাধারণ ভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। নইলে ধর্ষণের মতো কারণে অবাঞ্ছিত মাতৃত্ব এবং ভ্রূণের গড়নে অস্বাভাবিকতা ধরা পড়লে তা থেকে মুক্তির রাস্তা নেই।
গণভোটে আয়ারল্যান্ড যে ‘হ্যাঁ’ বলল, সেটা অতএব কোনও হুটহাট সিদ্ধান্ত নয়, নাটকীয় প্রচারের হাওয়ায় ভেসে যাওয়া নয়। তুল্যমূল্য বিচার করে, যুক্তি দিয়ে বুঝে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে একটা নির্ণায়ক অবস্থান নেওয়া। সেই দোলা এখন লাগতে চলেছে ব্রিটেনের অন্তর্গত নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডেও। সেখানে আইন পরিবর্তনেও ডাক দিচ্ছেন ব্রিটিশ এমপি-দের একাংশ। সময়ের নাড়ি টিপে আয়ারল্যান্ডের আর্চবিশপ কবুল করছেন, ‘‘মায়ের জীবনও যে সমান দামি, সেটা আমাদের মনে রাখতে হবে।’’
অবশ্যই মনে রাখতে হবে। সেই সঙ্গে যেন মনে রাখি, আয়ারল্যান্ডের গণভোট আরও এক বার দেখিয়ে দিল, মন বদলালে দিন বদলায়। বিপ্লব কবে আসবে সুপর্ণা, বলে হাপিত্যেশ করার দরকার হয় না। আর মন বদলের কাজটা করার জন্য নিরন্তর প্রয়াস লাগে, স্লোগানকে জীবনের সঙ্গে মেলাতে লাগে। বায়বীয় বুকনির বদলে নির্দিষ্ট ও আয়াসসাধ্য লক্ষ্য নিয়ে এগোতে লাগে। আয়ারল্যান্ডের মানুষ প্রমাণ করেছেন, ‘হ্যাঁ’-এর জোর কতটা। এ দেশ বিদ্বেষ, হিংসা আর কট্টরবাদের বিরুদ্ধে ‘না’ বলতে চায় কি না, আখলাক-রোহিত-জুনেইদ-পেহলু-আফরাজুলের অভিশাপ মাথায় নিয়ে সেটা দেশের মানুষকেই ঠিক করতে হবে। জামাল মোমিনের কাছে নতমস্তকে ক্ষমা চেয়ে বলতে হবে, আপনি ভয় পাবেন না, আমরা সবাই ইতর হয়ে যাইনি।