সুদিনের অপেক্ষায়। ফাইল ছবি
‘নারী হয়ে কেউ জন্মায় না, বরং নারী হয়ে ওঠে।’ ১৯৫৯ সালে সিমোন দ্য বোভোয়া বলেছিলেন। শিশু তার লিঙ্গ সম্পর্কে সচেতন থাকে না। চুলে ফিতে বেঁধে, ফ্রক পরিয়ে, হাতে পুতুল তুলে দিয়ে তাকে ‘নারী’ হিসেবে নির্মাণ করে সমাজ। ‘নির্মাণ’ কিন্তু এখানেই থেমে থাকে না। সব জায়গায় একটা অবদমনের চেষ্টা চলেছে। ঠিক এই মুহুর্তে আমরা কোন বিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছি তা বুঝতে গেলে ইতিহাসে ফিরতে হবে। আদি মানবী ‘লুসি’ (প্রাচীনতম মানবীর জীবাশ্ম) স্বাভাবিক ভাবেই কোনও নারীবাদী মিছিলে সামিল হননি। কারণ, লিঙ্গবৈষম্য সভ্যতার আমদানি করা। সেই সভ্যতা, ‘জোর যার মুলুক তার’-কে কাজে লাগিয়ে মেয়েদের মস্তিষ্কে তালা দিয়ে রাখল। কিন্তু কোনও তালাই অনন্ত কাল টেকে না। এ দেশে গার্গী, খনা, হটি ও দেশে মেরি ওলস্টৌনক্র্যাফটরা জন্মান। ১৭৯২ সালের রক্ষণশীল ইংল্যান্ডেও ‘আ ভিনডিকেশন অফ দ্য রাইটস অব ওম্যান’-এর মতো বইও লেখেন। মেরি দাবি করেছিলেন, সমশিক্ষা, সমমর্যাদার। কম মজুরি, কাজের সময় বেশি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ— এমন চরম লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে ১৮৮৭ সালে আমেরিকার সুতো কারখানার নারী শ্রমিকেরা আন্দোলন শুরু করেন। সেই সুতো আরও পাকাতে লেগে গেল কয়েক দশক। ১৯১০ সালে ‘ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট ওমেন্স কনফারেন্স’-এ ৮ মার্চ দিনটিকে নারীদিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। অনেকেই সেই দাবি মেনে নেন। ১৯৭৫ সালে, রাষ্ট্রসঙ্ঘ দিনটিকে আন্তর্জাতিক সিলমোহর দেয়।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষে ও বিংশ শতাব্দীর শুরুকে পশ্চিমী নারীবাদের প্রথম ঢেউ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সেই ঢেউ আছড়ে পড়েছিল আমেরিকা, ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, কানাডায়। প্রধান দাবি ছিল, মহিলাদের ভোটাধিকার। ১৯৬০ সালে সূচনা হয়, নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গের। সব রকম লিঙ্গবৈষম্য দূর করা, সব রকম কাজের অধিকার, প্রজনন ও গর্ভপাতের অধিকার, যৌনতার অধিকারের মতো দাবি সেই তরঙ্গের আঘাতে সামনে উঠে আসে। ১৯৯২ সালে রেবেকা ওয়াকার কলম ধরলেন অনিটা হিলের বিখ্যাত ঘটনা সম্পর্কে। এনিটা কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির অভিযোগে করেছিলেন তাঁর এক সময়ের উর্ধ্বতন ক্লেরেন্স থমাসের বিরুদ্ধে। ক্লেরেন্স থমাসের আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি হওয়ার পথে তা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। শেষ পর্যন্ত সেনেট ৫২-৪৮ ভোটে ক্লেরেন্স থমাস বিচারপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। প্রতিবাদে গর্জে ওঠে নারীসমাজ। রেবেকা লিখলেন, ‘‘আমি উত্তর নারীবাদ। নারীবাদী নই। আমিই তৃতীয় তরঙ্গ।’’ ধীরে ধীরে তৃতীয় তরঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার, বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার, পারিবারিক হিংসারোধ, বৈবাহিক ধর্ষণের মতো বিষয়। নানা ধরনের দাবির কারণে, আন্দোলনের কাঠামোটি দীরে ধীরে ব্যক্তিবাদী আকার নিয়েছে।
প্রথম তরঙ্গে যেমন আইনি লড়াইয়ের জয় এসেছিল, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তরঙ্গেও কিছু ক্ষেত্রে তা ঘটল। ভারতে ইন্দিরা জয়সিংহদের লড়াই থেরে ২০০৫ সালে পাশ হল ‘গার্হস্থ্য হিংসা প্রতিরোধ আইন’। ললিতা শেঠদের আন্দোলনের দাবি ধরে ২০০৫ সালে হিন্দু মহিলাদের সম্পত্তির সম উত্তরাধিকার আইন পাশ হল। মীনাক্ষী অরোরাদের দাবি পূরণ হল ২০১৩ সালে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি রোধ আইন পাশের মধ্যে দিয়ে। আইন তো পাশ হল, কিন্তু তার প্রয়োগ? সমীক্ষা বলছে, শতকরা আশি শতাংশ মহিলা কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বা অবাঞ্ছিত স্পর্শের শিকার, দেশের মোট জমির মাত্র ১৬ ভাগের মালিক মহিলা। চতুর্থ জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সার্ভে (এনএফএইচএস) অনুযায়ী প্রতি তিন জন মহিলার এক জন আজও গার্হস্থ্য হিংসার শিকার!
আন্তজার্তিক মহিলা দিবসে এই বিশেষ দিনগুলি সম্পর্কে জানেন?
এই ব্যর্থতা সত্ত্বেও ‘ঠোঁটে আঙুল, চুপকথা’ পর্যায় পেরিয়ে খোলাখুলি কথা বলা তো শুরু হল। নিন্দা বা অভিনন্দনের তোয়াক্কা না করে ‘স্লাট ওয়াক’-এর মতো মুভমেন্ট, ‘দ্য ভ্যাজাইনাল মোনোলগস’-এর মতো নাটক, সিনেমা উঠে এল। বিশ্বজুড়ে মেয়েদের সব রকম ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় আসতে শুরু করার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে এ ঝাপট। সাম্প্রতিক সংযোজন ‘মি টু’ আন্দোলন।
সমাজতান্ত্রিক, চরম, ইনটারসেকশনাল— তাত্ত্বিক দিক থেকে নারীবাদের অনেক রকম কাঠামো, শাখা। সে সব কথায় গেলে, যে কথাটা বলা জরুরি তা বলা হয়ে উঠবে না। উত্তর ‘উত্তর-আধুনিক’ সময়ে দাঁড়িয়ে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বায়নের পরে সমাজে যে বিরাট আর্থ-সামাজিক বৈষম্যে তৈরি হয়েছে তার কারণে আগের মতো মেয়েদের সার্বিক ভালমন্দ নিয়ে আন্দোলন দানা বাঁধছে না। এখন নারীবাদী বিষয়গুলির দিকে তাকালেই তা মালুম হয়। সমাজের উপরতলা যখন পোশাক পরার স্বাধীনতার সন্ধান করছে, তখন অন্য অংশ ক্যানিং লোকালে প্রবল ভিড়ে তাঁর পুরোনো শাড়িটিকে বাঁচাতেই ব্যস্ত। সমাজের উপরতলা যখন, পরিবারের ভিতরে শ্রমের সাম্য খুঁজছে। নীচের তলা তখনও মদ্যপ স্বামীর অত্যাচার থেকে বাঁচতে চাইছে।
সমাজের দুই অংশের সংলাপ মধ্যবর্তী শূন্যতায় আটকে যাচ্ছে। দু’টি আলাদা ঘুর্ণি, দু’টি আলাদা বৃত্তে ঘুরছে। দু’টি কণ্ঠস্বর মিলছে না। নারীসমাজের মিলিত কন্ঠ হয়ে উঠতে পারছে না। মেয়েদের দাবি ও অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে, অর্থনৈতিক বৈষম্য ধূ ধূ মাঠ রেখেছে পেতে। যা পেরনো কঠিন। তাই নারীবাদী লড়াইয়ের আগেই এসে যাচ্ছে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই। যেখানে এই ফারাক নেই,সেখানে সমাজে অনুরণন উঠছে। হচ্ছে প্রতিবাদ। যেমন, ধর্ষণের বিরুদ্ধে লড়াই। এই নারীবাদের লড়াইয়ে এলজিবিটি গোষ্ঠীকেও সঙ্গে নিতে হবে।
আসলে দরকার এক চতুর্থ তরঙ্গের। যার প্রবল ঝাপট, বর্ণভিত্তিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক— নারীবাদের মাঝের এ সব বৈষম্যকে ভাসিয়ে দেবে। সব মেয়েদের এক বৃত্তের মধ্যে নিয়ে আসবে। অপেক্ষায় রইলাম।
দুর্গাপুরের চিকিৎসক ও সংস্কৃতি কর্মী