ভারত এখনও জিএসটি-র জন্য তৈরি কি?

জিএসটি আসলে কী? কর মূলত দু’রকমের, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ করের মধ্যে পড়ে আয়কর, সম্পত্তি কর ইত্যাদি, যা মানুষ সরাসরি সরকারকে দেয়।

Advertisement

সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০১৭ ১০:০০
Share:

প্রতিবাদ: ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ‘অনলাইন’ ব্যবস্থায় অভ্যস্ত নয়, এ দিকে জিএসটি-র সমস্তটাই সফ্‌টওয়্যার পরিচালিত। তাই রাগ, উদ্বেগ। ছবি: পিটিআই

এসে গেল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সংসদে শঙ্খধ্বনির সঙ্গে কলিযুগ কাটিয়ে ভারত প্রবেশ করল জিএসটি যুগে। ১৯৫৪ সালে প্রথম ফ্রান্সে চালু হয় জিএসটি। তার পর এক এক করে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই লাগু হয়ে গেছে এই ট্যাক্স পদ্ধতি। বিশ্বের ১৬৬তম দেশ হিসেবে এ বারে ভারত। এর আগে, বাজপেয়ী চেষ্টা করেছিলেন চালু করতে, বিশেষ কলকে পায়নি সেই প্রয়াস, এমনকী বিজেপির কাছেও। তার পর কংগ্রেস চেষ্টা করেছিল সর্বোচ্চ ১৮% হারে জিএসটি চালু করতে, বিজেপির প্রবল বিরোধিতায় তা সম্ভব হয়নি। এখন সর্বোচ্চ ২৮% হারে কর ওই আসে ওই অতি ভৈরব

Advertisement

হরষে। এই হার প্রায় সব দেশের তুলনায় বেশি। সুকৌশলে পেট্রল-ডিজেলকে এর বাইরে রাখা হয়েছে, কারণ তার উপরে এর অনেক বেশি হারে ট্যাক্স নেয় সরকার।

জিএসটি আসলে কী? কর মূলত দু’রকমের, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ করের মধ্যে পড়ে আয়কর, সম্পত্তি কর ইত্যাদি, যা মানুষ সরাসরি সরকারকে দেয়। আর পরোক্ষ কর লাগু হয় যখন কোনও পণ্যসামগ্রী বা পরিষেবা কেনাবেচা হয়। এত দিন নানা রকম কর চালু ছিল এই ক্ষেত্রে— বিক্রয় কর, যুক্ত-মূল্য কর (ভ্যাট), আবগারি শুল্ক, পরিষেবা কর, বিনোদন কর, ইত্যাদি। এখন সবই চলে আসবে একটি ছাতার তলায়, গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স— পণ্য ও পরিষেবা কর। তাই উঠেছে স্লোগান: এক দেশ, এক কর, এক বাজার।

Advertisement

শুনতে বেশ ভাল। খোলনলচে বদলাতে চলেছে ভারতের কর-কাঠামোয়, সন্দেহ নেই। এতে ব্যবস-বাণিজ্যে কর-ব্যবস্থা সরল হওয়া উচিত। আশাবাদী বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সরলীকরণের ফলে দেশের জিডিপি (মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন) এক থেকে দেড় শতাংশ বাড়ার সম্ভাবনা। ভ্যাট যখন চালু হয়, খানিকটা আশা ছিল, একই পণ্যের ওপর একাধিক বার কর চাপার সমস্যা কমবে। বাস্তবে ততটা হয়নি। এ বারে আশা, একটা একক কাঠামোর মধ্যে চলে আসবে সব কিছু। আর পাতা-জোড়া বিজ্ঞাপন দিয়ে সরকার বোঝাতে চেষ্টা করছে, আসলে জিএসটি-র রিটার্ন দাখিল করা বেশ সহজ। তার জন্য তৈরি হয়েছে একটি সফ্‌টওয়্যার, যার প্রতি মাসে তিনশো কোটি লেনদেনের তথ্য ধরে রাখার ক্ষমতা আছে।

তা হলে আশঙ্কার মেঘ কোথা থেকে আসছে? দেশ জুড়ে বাণিজ্য-মহলে এত ভয় ও দুশ্চিন্তা কেন? বিভিন্ন জায়গায় ধর্মঘট আর ব্যবসা বিরতির তোড়জোড় কেন? বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প শঙ্কিত কেন? কারণ, দেশ জুড়ে এই জিএসটি ব্যবস্থা পরিচালিত হবে একটি সফ্‌টওয়্যারের মাধ্যমে। সমস্তটা অনলাইন। তাই দেশের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদেরও এই অনলাইন ব্যবস্থায় মানিয়ে নিতে হবে, বিশেষ করে তারা যদি মাঝারি বা বড় সংস্থার সঙ্গে ব্যবসা করতে চায়। কারণ, আমি আমার বিক্রয়মূল্যের সঙ্গে প্রদেয় করের ক্ষেত্রে ততটা ছাড় পাব, যতটা কর আমি আমার কাঁচামাল কেনার সময় দিয়েছি, যদি আমি যার থেকে কিনেছি সে ঠিক তথ্য জমা করে। সেখানে যদি এক টাকারও এ দিক-ও দিক হয়, তা হলে আমার দেয় করে কোনও ছাড় তো হবেই না, উপরন্তু জরিমানা দিতে হতে পারে। তাই, তথ্যপ্রযুক্তি ও তার ব্যবহারে একটা সর্বব্যাপী প্রগতি আসতে হবে জিএসটি-কে সফল করতে, নইলে ক্রেতা আর বিক্রেতার মধ্যে সম্পর্ক আর লেনদেন তলানিতে ঠেকতে পারে।

দেশের একেবারে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত তথ্যপ্রযুক্তি, টেলিকম, ইন্টারনেট পরিষেবা পৌঁছে যাওয়ার আগেই এই বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা জারি করায়, সেই মুরগি ও ডিমের প্রহেলিকাটির আভাস স্পষ্ট। বড় বড় সংস্থাগুলি হয়তো প্রস্তুত, কারণ তাদের সেই লোকবল, পরিকাঠামো, জ্ঞান বা পরামর্শদাতা আছে। কিন্তু ক্ষুদ্র সংস্থাগুলি? তারা এই ঝড় সামলাতে পারবে তো? দেশের ৯৩% কর্মসংস্থান এই ক্ষেত্রে, তাই সব মহলেরই আশঙ্কা, ‘নোট-বাতিল’র পর আবার এক বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দেশের অসংগঠিত অর্থনীতি। নভেম্বর মাসের আশঙ্কা সত্যি করে কৃষিক্ষেত্রে নেমে এসেছে সংকটের আকারে— অনেক বছর পর রবিশস্যে ভাল ফলন সত্ত্বেও চাষি তার ফসলের দাম পাচ্ছে না, বিভিন্ন রাজ্যে আগুন জ্বলছে, আর আত্মহত্যার মিছিল। অনেক চেষ্টা করেও জিডিপি বৃদ্ধিতে মন্দার তথ্য প্রকাশ ঠেকানো যায়নি। তার ওপর ছোট ব্যবসায় অশনি সংকেত। নোট-বাতিল আর জিএসটি-র যুগলবন্দি ডিজিটাল ভারতের ক্ষুদ্র আর প্রান্তিক জীবিকার মানুষদের কী হাল করবে?

এ ছাড়া আরও কিছু দুশ্চিন্তার কারণ আছে। জিএসটি-র কর্ণধার স্বীকার করে নিয়েছেন, সফ্‌টওয়্যারটি পরীক্ষা করে দেখার কোনও সময় পাওয়া যায়নি। ফলে একটি অপরীক্ষিত সিস্টেম-এ ভরসা করে ঝাঁপিয়ে পড়ছে আসমুদ্রহিমাচল। জাপান বা জার্মানির মতো উন্নত দেশও জিএসটি-র সার্বিক প্রয়োগ ধাপে ধাপে করতে এক বছরের বেশি সময় নিয়েছিল, সে রকম কোনও পরিকল্পনার ব্যাপার এ দেশে নেই।

আর আছে কেন্দ্র ও রাজ্যের টানাপড়েন। জিএসটি পদ্ধতিতে রাজ্যের একটা রাজস্ব ঘাটতি হবে, কারণ এত দিন যে করগুলি রাজ্যের আওতায় ছিল, সেগুলিও এখন কেন্দ্র আর রাজ্যের মধ্যে সমান ভাবে ভাগ হবে। ফলে, কেন্দ্রকে আরও বেশি করে রাজ্যকে ভর্তুকি দিতে হবে, তাতে দেশের অর্থনীতিতে রাজ্যের তুলনায় কেন্দ্রের ক্ষমতা আরও বাড়বে। সেখানে অবধারিত ভাবেই এসে যাবে রাজনীতির খেলা। এ ছাড়া এই ব্যবস্থায় যেহেতু বিক্রয়ের স্থানে কর প্রদেয়, তাই যে রাজ্যে ক্রয়ক্ষমতা বেশি, সেখানে কর আদায় বেশি। ফলে, রাজ্যগুলির মধ্যে অসাম্য বাড়ার সম্ভাবনা বেশি।

এ ছাড়াও, ‘এক দেশ এক কর’ স্লোগানটিতে একটু সমস্যা আছে। প্রতিটি লেনদেনে ব্যবসায়ীকে বাস্তবে দুটি কর দিতে হবে— অর্ধেক রাজ্যকে, অর্ধেক কেন্দ্রকে। তাতে ছাড়ের ক্ষেত্রেও নিয়মের তারতম্য আছে। আগে কেন্দ্রীয় উৎপাদন শুল্ক লাগু হওয়ার ক্ষেত্রে একটা ন্যূনতম ধার্যমাত্রা ছিল, কিন্তু এখন সমস্ত লেনদেন বাধ্যতামূলক ভাবে কেন্দ্রের আওতায় এসে পড়ল।

সব মিলিয়ে, বেশ একটা অগোছালো অবস্থায় ঝাঁপ দিল ভারত, আজকের ভোর থেকে। জিএসটি-র দীর্ঘমেয়াদি সুফল পৃথিবীর বহু দেশেই পরীক্ষিত। দেশের প্রচলিত কর-ব্যবস্থায় অনেক ফাঁকফোকর আছে, সেগুলোকে ঠিকঠাক করতে একটি নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে আনার প্রয়াস তো করতেই হবে। কিন্তু যেখানে শহুরে ইন্ডিয়া আর গ্রামীণ ভারত প্রায় দুটো আলাদা দেশ, সেখানে এত তাড়াহুড়ো করে, সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষুদ্র ও মাঝারি সংস্থাকে এই স্রোতে আনার একটা সংহত উদ্যোগ না নিয়ে, একটা সম্পূর্ণ নতুন কর-ব্যবস্থা চাপানোর অভিঘাত সহ্য করতে এ দেশ কি প্রস্তুত?

ইনকিউব ইনোভেঞ্চার্স-এর অধিকর্তা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement