ক্লাসঘরে একটু নীতিবিদ্যার পাঠ?

ডাক্তার ও রোগীর সম্পর্ক। এই সম্পর্ক প্রায় জীবনের মতোই প্রাচীন, বিশ্বাসের গ্রন্থির মতো নির্ভেজাল। বলতে দ্বিধা নেই, আজ এই গ্রন্থির বন্ধনে টান পড়েছে, পারস্পরিক বিশ্বাসে চিড় ধরেছে।

Advertisement

সুমিত চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০১৮ ০১:১৩
Share:

ফাইল চিত্র।

আমাদের সামাজিক সম্পর্কগুলো নিয়ে চর্চা বা আলোচনা বন্ধ হওয়ার নয়। যেমন, স্বামী-স্ত্রী মা-বাবা ও সন্তান, শিক্ষক ও ছাত্র, বা ডাক্তার ও রোগীর সম্পর্ক। আমাদের প্রতি দিনের বেঁচে থাকার সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে থাকে এই সব সম্পর্কের নির্যাসসঞ্জাত জীবনবোধ, আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক অবস্থান স্থির করে।

Advertisement

এই লেখার উপজীব্য: ডাক্তার ও রোগীর সম্পর্ক। এই সম্পর্ক প্রায় জীবনের মতোই প্রাচীন, বিশ্বাসের গ্রন্থির মতো নির্ভেজাল। বলতে দ্বিধা নেই, আজ এই গ্রন্থির বন্ধনে টান পড়েছে, পারস্পরিক বিশ্বাসে চিড় ধরেছে। ডাক্তারের কাছে নিজের প্রিয় জনকে ছেড়ে দিয়ে আমরা ক’জনই বা নিশ্চিন্ত হতে পারি আজকাল! ঈশ্বরপ্রতিম না তস্করপ্রতিম, এই প্রশ্ন আমাদের মনের অন্দরে ঘুরতে থাকে। উল্টো দিকে, ক’জন ডাক্তারই বা এখনও নিশ্চিন্তে তাঁর চিকিৎসা রোগীর উপর প্রয়োগ করেন? নিজের নৈতিক দায়িত্ব এবং শাস্ত্রের জ্ঞান পরিপূর্ণ বিশ্বাসে রোগীর আরোগ্যের তাগিদে ব্যবহার করতে সক্ষম হন? চিকিৎসককে অসুস্থ ব্যক্তির আত্মীয়ের রোষ থেকে উদ্ধার করতে হাসপাতালে পুলিশ ডাকতে হয় আজকাল। আত্মরক্ষার তাগিদে অনশনে বসতে বাধ্য হন চিকিৎসক। কখনও বা পুলিশ নিজেই চড়াও হন ডাক্তারের উপর।

এই জটিল অসুখ কি সমাজের অন্তর্গত ক্ষয়ের ক্লেদ বহন করছে? ভাবতে বসে হাতে আসে পল কলানিথির লেখা ‘হোয়েন ব্রেথ বিকামস এয়ার’ নামক বইটি (২০১৬)। আমেরিকাবাসী এক মেধাবী চিকিৎসকের আত্ম-অন্বেষণ, চিকিৎসাশাস্ত্র ও তার প্রয়োগ-সংক্রান্ত জিজ্ঞাসার দলিল, ডাক্তার-রোগী সম্পর্ক আর তন্নিহিত নৈতিক আত্মজিজ্ঞাসার নির্মম আখ্যান। কেমন হবেন চিকিৎসক? কতখানি অবধি তাঁর দায়িত্ব? মুমূর্ষুর সঙ্গে চিকিৎসকের সম্পর্কের গ্রন্থিকে কী ভাবে ব্যাখ্যা করবেন তিনি? উত্তর খোঁজেন কলানিথি এই বইয়ের প্রথম পর্বে।

Advertisement

এক পঁয়ত্রিশ বছর বয়সি রোগিণীর কথা লিখছেন কলানিথি। তিনি শুয়ে রয়েছেন ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে। অকস্মাৎ জ্ঞান হারিয়ে হাসপাতালে আসেন। ছবিতে দেখা যাচ্ছে তাঁর মস্তিস্কে ‘বিনাইন’ টিউমার, অস্ত্রোপচারে সম্পূর্ণ রোগমুক্তি হতে পারে, না হলে বাকি জীবন বিষাক্ত ওষুধ হবে তাঁর সঙ্গী। কলানিথি লিখছেন, তিনি এই রোগিণীর আশঙ্কাধ্বস্ত অবস্থা অনুধাবন করছেন, বুঝতে পারছেন এখন তিনি ওঁকে অস্ত্রোপচারের বিবিধ বিপদ এবং জটিলতা ব্যাখ্যা করতেই পারেন, তার পর সন্ত্রস্ত রোগিণীর ‘অরাজি’ হওয়ার তথ্য নথিবদ্ধ করে নিজের কর্তব্য পালন হয়েছে মনে করে পরের কাজে মন দিতেই পারেন। কিন্তু না, পরিবর্তে তিনি পরিজনদের ডেকে পাঠালেন। এক সঙ্গে বসে আলোচনা করে ওঁকে রাজি করাতে পারলেন। অপারেশন হল। রোগিণী সুস্থ হলেন।

এই বই চিকিৎসক হিসেবে কলানিথির নৈতিক দায়িত্বের আখ্যান। চিকিৎসাশাস্ত্রের অন্দরে এক দিকে যে অন্তঃসারশূন্য প্রথানুগত্য, আর অপর দিকে যে বৃহত্তর মানবিক চেতনা, তার সংঘাতের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে একটা স্থির সত্যে উপনীত হচ্ছেন তিনি বার বার, ডাক্তার এবং রোগীর মানবিক সম্পর্কের একটি সত্যে: তাঁর কাজ জীবন বাঁচানো নয়, কেননা মৃত্যু এমনিতেই এক অবধারিত পরিণতি, তাঁর কাজ হল অসুস্থতার মধ্য দিয়ে রোগীকে আর তাঁর পরিজনদের যে এগিয়ে যাওয়া, তার তত্ত্বাবধান। যে কোনও চিকিৎসাপদ্ধতি শুরু করার আগে, রোগী বা তাঁর পরিজনকে সম্মতিপত্রে যে স্বাক্ষর করতে হয়, কলানিথির মতে সেই স্বাক্ষর শুধুমাত্র একটা আইনগত পদ্ধতি নয়, এই স্বাক্ষরের মুহূর্ত আসলে এক জন অসুস্থের সঙ্গে এক রকম মানবিকতার চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার মুহূর্ত— ‘‘আই ওয়াজ় নাউ অ্যাকসেপ্টিং ফুল রেসপনসিবিলিটি ফর মাই পেশেন্টস ওয়েল-বিয়িং।’’

ডাক্তারি পড়ার আগে কলানিথি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। রিচার্ড রর্টির মতো দার্শনিকের কাছেও কিছু দিন পড়েছেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এই সব কিছুর মিশেল: মেধা আর মননের সিম্ফনি। চিকিৎসাশাস্ত্র সম্বন্ধে এমন দার্শনিক পাঠ কিন্তু তিনি দূর থেকে লেখেননি। প্রতি দিন প্রায় আঠারো ঘণ্টা হাসপাতালে থাকবার অভিজ্ঞতা, ক্লান্তি, স্বেদ, বিফলতা, কিংবা সাফল্যের অন্দর থেকে তুলে এনেছেন এই আখ্যান। প্রতি দিনের এই অভিজ্ঞতায় যেমন সাফল্য রয়েছে, তেমনই রয়েছে অসাফল্যের বিষাদ।

কলানিথির বইয়ের এই পাঠের মাধ্যমে যা বলতে চাইছি, সেটা আমাদের নৈমিত্তিক সামাজিক চলাচলের অতীত। এখানে কে কাকে দোষ দিলেন, রোগীর প্রিয় জন সভ্য না অসভ্য, পুলিশের কী ভূমিকা, এই সব আলোচনা সরিয়ে রেখে একটু ভিতরে ঢুকতে চাইছি। যেখানে শুধু চিকিৎসক আর মুমূর্ষু। সেখানে অবিশ্বাসের দেওয়াল তৈরি হলে তার দায় নিশ্চিত ভাবেই চিকিৎসকের। তিনি এই বিশ্বাসের জায়গাটা স্থাপন করতে অক্ষম হচ্ছেন, কিংবা সেই চেষ্টাটুকু করছেন না। সময় অথবা ধৈর্য না থাকবার যে যুক্তি সরকারি হাসপাতালের ক্ষেত্রে হয়তো বা সত্যি হতেও পারে, বেসরকারি ব্যবস্থায় তা মেনে নেওয়া চলে না। সেখানে রোগীর সংখ্যা কম, অর্থের এবং ব্যবস্থার আয়োজনও বিপুল, হয়তো কম পড়ে যায় সহানুভূতি বা সেবার দিকটাই। খানিক সেবার বোধ থাকলে ভুল বোঝার দেওয়াল ভাঙতে পারে, চিকিৎসকেরও খানিক প্রাপ্তি হয়। সেবাকে কলানিথি কেবল সহানুভূতির প্রয়োগ হিসেবে দেখছেন না, ‘অ্যান এলিভেশন অব মাই ওন বিয়িং’ হিসেবে দেখছেন।

অবশ্যই সব চিকিৎসক এক রকম নন। তাও মনে হয়, কলানিথি যেমন মাস্টারমশাই পেয়েছিলেন, আজকের এখানকার ডাক্তারকুল হয়তো তা পাচ্ছেন না। নিজে মাস্টারমশাই বলে বুঝতে পারি ক্লাসঘরে নৈতিকতার পাঠ দেওয়া সহজ নয়। এর দায় সম্পূর্ণ ভাবে মাস্টারের— ছাত্রের নয়। যে চিকিৎসকের ভিতর সেবার অনায়াস চলাচল হয়নি, তার দায় হয়তো ওই ক্লাসঘরেই খুঁজে পাওয়া যাবে। ভুল বোঝার দেওয়াল আরও শক্ত হওয়ার আগে তাকে তাই আঘাত করা প্রয়োজন। তা হলে কি ডাক্তারির ক্লাসঘরে খানিক সাহিত্য বা দর্শনের চর্চা হলে ভাল? কে জানে!

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন