চিরকালের ‘কমন ম্যান’

‘‘দরিদ্র লোককে আমি দান করিব, তোমার বাবার কী?’’

বিদ্যাসাগর আরও কিছু, আরও মহৎ কোনও শক্তিপুঞ্জ যিনি সাধারণ্যে ‘কমন ম্যান’দের মধ্যে থেকে, নিজ পুরুষকারের জোরে উদ্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন করেছেন।

Advertisement

অশোককুমার মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০১৯ ০০:০১
Share:

বিদ্যাসাগরকে মনে রাখা কি শুধুই এক সমাজ-সংস্কারক হিসাবে?

বিদ্যাসাগর মানে কি শুধু বর্ণপরিচয়--প্রথম ভাগ দ্বিতীয় ভাগ, বেতাল পঞ্চবিংশতি-সহ তাঁর যাবতীয় শিশুভোগ্য স্কুলপাঠ্য বই? ভাষা আর শিক্ষা-সংস্কার? স্কুল-কলেজ স্থাপনা? অথবা বিদ্যাসাগর মানে কি শুধুই প্রবহমানতার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে শাস্ত্রের যুক্তি শানিয়ে বিধবা-বিবাহের প্রচলন? যদিও তিনি লিখেছেন, ‘বিধবাবিবাহ-প্রবর্তন আমার জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম’, তবুও বিদ্যাসাগরকে মনে রাখা কি শুধুই এক সমাজ-সংস্কারক হিসাবে?

Advertisement

যদি উত্তর হয় তাই-ই তো। এ কম নাকি! তাঁর কাজের ব্যাপ্তি তো বিশাল। বাংলা ভাষা যে অকাজের ভগ্নস্তূপে পড়েছিল তাকে উদ্ধার করে সাধারণের মুখে এনে দিয়েছেন। তাঁর সহোদর শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন থেকে এখনকার এই আমরা যে প্রকরণে লিখছি তা বিদ্যাসাগরেরই নির্মাণ।

শিক্ষার এমন কোনও বিভাগ ছিল না, যেখানে ঈশ্বরচন্দ্র অনুপস্থিত। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে বাংলা শ্রেণি খোলা হয় ১৫ জুন ১৮৫২। বাংলায় ডাক্তারি পড়বার দরখাস্ত জমা পড়ে তিনশো’র বেশি। বাংলার পরীক্ষক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। পাশ করল খুবই কম। কেন? ১২৫৯ বঙ্গাব্দের ৫ আষাঢ় তারিখের সংবাদ প্রভাকর জানাচ্ছে, ‘‘...৩২০ জন প্রার্থকের মধ্যে কেবল ২১ জন মাত্র পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছেন... ইহাতে বিশিষ্ট রূপেই বিবেচ্য হইতেছে যে এদেশের অধিকাংশ বাঙ্গালী যুবকেরা এপর্য্যন্ত বঙ্গভাষায় নৈপুণ্যলাভ করিতে পারেন নাই। আমরা প্রার্থি লোকের সংখ্যাদৃষ্টে মনে করিয়াছিলাম, ন্যূনকল্পে ১৫০ জন পরীক্ষা দিয়া অনায়াসে কৃতকার্য্য হইতে পারিবেন, কিন্তু কি পরিতাপ!...বাঙ্গালা রচনার নিমিত্ত পরীক্ষকেরা এই প্রশ্ন দিয়াছিলেন যে, ‘মিথ্যা কথনের ফল কি’। এই সহজ প্রস্তাব লিখিতেই যখন অক্ষম হইয়া পাল পাল যুবা মেষপালের ন্যায় পলায়ন করিল, এবং অনেকেই যখন শ্রীফাঁদিতে হতশ্রী হইল, আর অন্নদামঙ্গলের কবিতার উত্তরে, ‘নাম্‌তা জিজ্ঞাস্য বালকের ন্যায় আম্‌তা মুখে ফ্যা ফ্যা করিয়া ঠোঁট মুখ চাটিতে লাগিল’, তখন এদেশের কল্যাণ ও দেশীয় ভাষার উন্নতি কোথায়? তাহারা এখনো বহুদূরে রহিয়াছে।’’

Advertisement

এর পরেই, শিক্ষা কাউন্সিলের সচিব ডাক্তার মোয়াটের চিঠির উত্তরে ১৮৫২ সালের ১৩ জুলাই ঈশ্বরচন্দ্র বাংলা লিখিত পরীক্ষার পাঠক্রম ঠিক করে দিয়েছেন, ‘জীবনচরিত’ এবং ‘বাংলার ইতিহাস’ থেকে প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। অন্ততপক্ষে যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ এবং অনুপাতে সড়গড় হতে হবে। মৌখিক পরীক্ষার পাঠক্রম হল নীতিবোধ এবং বেতালপঞ্চবিংশতি। সাবলীল ভাবে এই বইয়ের নির্দিষ্ট অংশ পড়তে এবং ব্যাখ্যা করতে হবে। দ্বিতীয়, বাংলা ব্যাকরণের মূলসূত্রগুলি অন্তত জানা দরকার।

শিক্ষার মতোই সমাজের এগিয়ে চলাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে বিভিন্ন স্তরে, বিচিত্র কাজে তাঁর যাতায়াত। বন্ধু ডাক্তার দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রয়াত হলে তাঁর স্ত্রী জগদম্বা দেবীর অনুরোধে সম্পত্তি ভাগাভাগির পারিবারিক ঝগড়া মেটাতে ঈশ্বরচন্দ্র তালতলার বাড়িতে হাজির। তিনি সে-যুগের সর্বজনমান্য সালিশ। পাঁচ ছেলে: দেবেন্দ্রনাথ, সুরেন্দ্রনাথ, উপেন্দ্রনাথ, মহেন্দ্রনাথ আর জিতেন্দ্রনাথ—মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। বিলেতফেরত আইসিএস সুরেন্দ্রনাথ তখনই বাগ্মী হিসাবে খ্যাতিমান। সেই তাঁরও বিদ্যাসাগরের চোখে চোখ রাখার ক্ষমতা নেই। সব শুনে ঈশ্বরচন্দ্র যা রায় দিলেন তা এতই যুক্তিপূর্ণ, কোনও আপিল চলে না।

এ সবই জানাচেনা ঐতিহাসিক সত্য। তবু এই সব ছাড়িয়েও বিদ্যাসাগর আরও কিছু, আরও মহৎ কোনও শক্তিপুঞ্জ যিনি সাধারণ্যে ‘কমন ম্যান’দের মধ্যে থেকে, নিজ পুরুষকারের জোরে উদ্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন করেছেন। প্রতি পদে বুঝিয়েছেন, মানুষকে সামনে এগিয়ে যেতে হলে বাধা আসবেই, তাকে সরাতে লড়ে যেতে হবে বারংবার। তিনি সেই ‘ঘাড় কেঁদো’ বাঙালি যিনি বীরসিংহে স্কুল স্থাপনের জমিতে প্রথম কাজের দিন দিনমজুরেরা অনুপস্থিত দেখে ভাইদের সঙ্গে নিয়ে নিজেই কোদাল চালিয়ে মাটি খুঁড়তে শুরু করে দেন। অথবা সেই মানুষ যিনি পথিমধ্যে ছোট-ছোট ছেলেদের সঙ্গে কপাটি খেলে আমোদ পান। অথবা পাইকপাড়ার রাজবাড়ি যাবার পথে দরিদ্র মুদি রামধন খুড়োর আহ্বানে, গাড়ি থেকে নেমে তার দোকানে কয়েক দণ্ড বসে থেলো হুঁকোয় টান মারেন। তিনি চিরকাল এই কমন ম্যানদের মধ্যে সাধারণ মানুষের মতো থেকে অসামান্যতা স্পর্শ করতে পেরেছেন। তাঁর ক্রোধও সাধারণ মানুষের মতো ভয়ংকর, স্পষ্ট এবং আগ্রাসী। সাহায্যপ্রার্থী বৃদ্ধাকে অপমান করেছিল বাড়ির পঁচিশ বছরের পাচক হরকালী, তাকে সপাটে ভর্ৎসনা--‘‘দরিদ্র লোককে আমি দান করিব, তোমার বাবার কী?’’ এ তো আমাদের মুখের ভাষা, আমাদের উচ্চারণ!

এই জন্যই ঈশ্বরচন্দ্র পরিপূর্ণ মানুষ। এমন মানুষকেই আমরা মাথায় করে রাখতে চাই যার নিজস্ব ভগবান বাবা-মা এবং চারপাশের সাধারণ মানুষ। নিজ ক্ষমতায় বিশ্বাসী নাস্তিক মানুষটির মাথার পেছনে কোনও অলৌকিক জ্যোতির্বলয় দেখা যাবে না। স্বামী বিবেকানন্দ-ভগিনী নিবেদিতা-রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি সংগ্রহে নিজের নামটা সম্পাদক হিসাবে জুড়ে লেখক বনে তা বাজারজাত করা যায়। কিন্তু বিদ্যাসাগরের কোনও বাণী-সংহিতা করা যাবে না কারণ তাঁর কোনও ‘বাণী’ নেই, মানুষ বলেই নেই। তাঁর জীবন কিছু অসামান্য কর্মকাণ্ডের লেখচিত্র। যা আমরা স্পর্শ করতে পারি।

আজ এই নিদারুণ সময়ে, যখন অশুভ শক্তি কুযুক্তি, অর্ধসত্য, মিথ্যা শাস্ত্রবচন দিয়ে শিক্ষার প্রতিটি তন্তু, সমাজের প্রতিটি ন্যায়সূত্রকে ছিন্নভিন্ন করতে চাইছে, তার বিরুদ্ধে লড়তে আমাদের পুরোভাগে, আর কেউ নয়, বিদ্যাসাগর। তিনি হাতেকলমে শিখিয়ে দিয়েছেন, ইতিহাসের উল্লেখ করে যারা কুযুক্তির অবতারণা করছে, তাদের কাটতে আমাদের জানতে হবে ইতিহাসের যুক্তি। বিজ্ঞানকে খাটো করতে চাইছে যারা তাদের উত্তর দৃশ্যমান উপস্থাপনায়। ভুল শাস্ত্রের উল্লেখ জবাব দিতে হবে অক্ষরে-অক্ষরে। এই সবই দেবতার অসাধ্য কিন্তু মানুষের আয়ত্তাধীন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন