National news

আত্মসমর্পণ বা প্রশ্রয়, নৈরাজ্যের ক্ষণে কোনওটিই কাম্য নয়

শিল্পের তথা শিল্পীর যে স্বাধীনতা যুগে যুগে স্বীকৃত, তাতেও অসহনীয় কোপ পড়েছে। এত কিছুর পর ছবির মুক্তির দিনক্ষণ স্থির হয়েছিল। বাধা তবু সরল না। চূড়ান্ত নৈরাজ্য হাতিয়ার হয়ে উঠল উগ্র জাতীয়তাবাদীদের।

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:৩৬
Share:

পদ্মাবত ছবির একটি দৃশ্য।

নৈরাজ্যের যথার্থ নিদর্শন সম্ভবত এটাই। শত চেষ্টাতেও আইনের শাসন কার্যকর হওয়ার উপায় নেই যেন। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের স্পষ্ট নির্দেশ সত্ত্বেও সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করার পথ মিলছে না। হিন্দি ছবি ‘পদ্মাবত’-এর মুক্তিকে ঘিরে যে ব্যূহ রচিত হয়েছে, তাতে যেন পথ হারিয়ে ফেলেছে প্রশাসন। কোনও গণতান্ত্রিক এবং প্রগতিশীল কাঠামোর জন্য এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ছবি আর কী হতে পারে!

Advertisement

প্রলম্বিত অশান্তি এবং অশান্তির আগুন ক্রমশ লেলিহান। জট অনেকটাই জটিল ছিল সঞ্জয় লীলা ভন্সালীর ছবিকে ঘিরে। আইন, আদালত, প্রশাসন, রাজনীতি, সেন্সর বোর্ড— নানা দরজায় ঘুরে ঘুরে একে একে জট কাটিয়েছেন ছবিটির নির্মাতারা। ছবির নাম বদলাতে হয়েছে। ছবির একের পর এক দৃশ্য ছাঁটতে হয়েছে। শিল্পের তথা শিল্পীর যে স্বাধীনতা যুগে যুগে স্বীকৃত, তাতেও অসহনীয় কোপ পড়েছে। এত কিছুর পর ছবির মুক্তির দিনক্ষণ স্থির হয়েছিল। বাধা তবু সরল না। চূড়ান্ত নৈরাজ্য হাতিয়ার হয়ে উঠল উগ্র জাতীয়তাবাদীদের।

রাজপুত করণী সেনা গত কয়েক দিন ধরেই আগুনে ঘি ঢালছিল। প্রেক্ষাগৃহে হিংসাত্মক হানাদারির অবিরাম শাসানি চলছিল। রাজপুত রমণীরা গণ-আত্মাহুতির পথ ধরবেন বলেও হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। পদ্মাবত-এর মুক্তির ঠিক আগের দিন আগুন দাউদাউ করে উঠল। শাসানিকে সত্য প্রমাণ করে হরিয়ানায়, রাজস্থানে, গুজরাতে পরিস্থিতি হিংসাত্মক হয়ে উঠল। পদ্মাবত মুক্তি পেলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হল।

Advertisement

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

দেশের সর্বোচ্চ আদালত ‘পদ্মাবত’-এর নির্বিঘ্ন এবং মসৃণ মুক্তি চাইছে। ছবির মুক্তি যাতে কোনও ভাবে বাধা না পায়, প্রশাসনকে তা নিশ্চিত করতে বলেছে সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশও মান্য নয় একদল উন্মত্তের কাছে। ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, সম্পত্তিহানি, প্রয়োজনে প্রাণহানি— অরাজকতার সব রকম পথ খুলে দিয়ে পদ্মাবত-এর প্রদর্শন রুখতে বদ্ধপরিকর এই উন্মত্তরা।

দু’টি গুরুতর বিষয় অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠছে এই পরিস্থিতি থেকে। প্রথমত, জাতিগৌরব এবং রাজপুত অস্মিতার নামে উগ্রতা এবং ঘৃণা চারিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর দ্বিতীয়ত, স্বেচ্ছায় হোক বা অপদার্থতায়, উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রশাসন সম্পূর্ণ ব্যর্থ।

রাজপুত করণী সেনা এবং অন্য যাঁরা পদ্মাবত-এর বিরোধিতায় উন্মত্ত, তাঁরা রাজপুত জাতির গৌরবের কথা বলে তথা রাজপুত অস্মিতার কথা বলে পথ নেমেছেন। জাতিগৌরব বা অস্মিতা যত ক্ষণ জাতির আত্মবিশ্বাস বাড়ায়, তত ক্ষণ তা ইতিবাচক। কিন্তু জাতিগৌরব বা অস্মিতা যখন হিংসাত্মক হয়ে ওঠে, তখন বোঝা যায়, নেপথ্যে রয়েছে সমুদ্রপ্রমাণ ঘৃণা। এই ঘৃণা কোনও অর্থেই ইতিবাচক নয়। রাজনৈতিক স্বার্থে এই ঘৃণার বাড়বাড়ন্তকে প্রশ্রয় দেওয়াও অত্যন্ত বিপজ্জনক।

আরও পড়ুন: দেশ জুড়ে উন্মত্ত করণী সেনা, চার রাজ্যে মাল্টিপ্লেক্সে বন্ধ প্রদর্শনী

হিংসাত্মক পথে হিন্দি ছবিটির প্রদর্শন বন্ধ করার চেষ্টা চলছে। সর্বোচ্চ আদালত নির্দেশ দিয়েছে, হিংসা থামাতেই হবে, সর্বত্র পদ্মাবত-এর নির্বিঘ্ন প্রদর্শন সুনিশ্চিত করতে হবে। অনেক জায়গাতেই প্রশাসনের হাবভাব দেখে একেবারেই মনে হচ্ছে না যে অশান্তি রোখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা তাদের রয়েছে। উন্মত্ত এবং উগ্র জাতীয়তাবাদীদের তা হলে কি ভয় পাচ্ছে প্রশাসন? সেই কারণেই কি হিংসাত্মক বিক্ষোভের মুখোমুখি দাঁড়াতে পুলিশ দ্বিধাবোধ করছে? নাকি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে চলতে দেওয়া হচ্ছে বিক্ষোভের নামে এই বর্বরতা? সত্য যা-ই হোক, প্রশাসনিক অপদার্থতাই তাতে প্রকট হয়। নৈরাজ্য রুখতে না পারা বা রাজনীতির সঙ্গে হাত মিলিয়ে নৈরাজ্যের সঙ্গে আপোস করা— দুই-ই প্রশাসনিক অপদার্থতার পরিচায়ক। আদালতের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে রূপায়ণ করা প্রশাসনের অলঙ্ঘনীয় কর্তব্য। সেই কর্তব্য যে লঙ্ঘিত হচ্ছে, তা গোটা দেশই দেখতে পাচ্ছে।

নৈরাজ্যকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করা বা নৈরাজ্যের শরিক হওয়া বা নৈরাজ্যের সঙ্গে পেরে না ওঠা বা নৈরাজ্যের সঙ্গে সমঝোতা করা— কোনওটিই প্রশংসনীয় নয়, বলাই বাহুল্য। দেশের সরকার তথা সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলির সরকার প্রশংসনীয় কাজ যে কেউই করছে না, তা সাদা চোখেই ধরা পড়ছে। শাসকরা যদি ভাবেন, চোখে ধুলো দিতে তাঁরা সক্ষম হচ্ছেন, তা হলে মস্ত ভুল হচ্ছে। সে ভুল অবিলম্বে সংশোধন করে নেওয়া জরুরি। না হলে বিপদ সবারই অপেক্ষায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন