Newsletter

সেই ক্ষুদ্রতা সমানে চলেছে

এই প্রয়াণ একটা যুগের অবসানের মতোই। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় সেই প্রজন্মের রাজনীতিক, যে প্রজন্ম দলীয় গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে বা যাবতীয় ক্ষুদ্রতার ঊর্ধ্বে উঠে প্রকৃত রাষ্ট্রনায়ক হতে শিখিয়েছিল অনেককে।

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০১৮ ০০:৩৬
Share:

সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় (১৯২৯-২০১৮)

ভারতীয় গণতন্ত্রের আকাশে নক্ষত্রের মতো অস্তিত্ব ছিল যাঁর, সেই সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় চলে গেলেন। আক্ষরিক অর্থেই এক নক্ষত্র পতন ঘটল। গোটা দেশের রাজনৈতিক শিবির শোকস্তব্ধ, শ্রদ্ধাবনত সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণে। শুধু সৌজন্যের শোক বা গণতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতার শ্রদ্ধাজ্ঞাপন কিন্তু নয়, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণ আন্তরিক ভাবেই দুখী করেছে অনেককে। দুখী করেছে বলেই কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন লোকসভার স্পিকার সুমিত্রা মহাজন, দুখী করেছে বলেই কথা বলতে বলতে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। এ সবের প্রধান কারণ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের অসমান্তরাল ব্যক্তিত্ব, তাঁর প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য, তাঁর অসীম রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, মানুষ হিসেবে তাঁর বিরাট উচ্চতা এবং দীর্ঘ রাজনৈতিক যাত্রার সুবাদে প্রকৃত অর্থেই ভারতীয় গণতন্ত্রের অন্যতম অভিভাবক হয়ে ওঠা।

Advertisement

এই প্রয়াণ একটা যুগের অবসানের মতোই। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় সেই প্রজন্মের রাজনীতিক, যে প্রজন্ম দলীয় গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে বা যাবতীয় ক্ষুদ্রতার ঊর্ধ্বে উঠে প্রকৃত রাষ্ট্রনায়ক হতে শিখিয়েছিল অনেককে। ইন্দিরা গাঁধী বা অটলবিহারী বাজপেয়ী, জয়প্রকাশ নারায়ণ বা মোরারজি দেশাই, জ্যোতি বসু বা ইএমএস, ভূপেশ গুপ্ত বা হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় যে হাওয়াতে শ্বাস নিতেন, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ও সেই হাওয়ারই রাজনীতিক ছিলেন। কিন্তু প্রকাণ্ড রাজনৈতিক উচ্চতার এই সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে ঘিরে অনেক ক্ষুদ্রতা, সঙ্কীর্ণতা, নির্বুদ্ধিতার অবস্থান ছিল দলীয় পরিসরে। সে সবের মাঝে দাঁড়িয়ে বা সে সবকে সঙ্গে নিয়েই রাজনীতি করতে হয়েছে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে। ফলে দল থেকে বহিষ্কারের মতো সিদ্ধান্তও তাঁকে দেখতে হয়েছে। এ বার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় নিজের মৃত্যুতেও প্রমাণ করলেন যে, সিপিএম এখনও সেই ক্ষুদ্রতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

স্বনামধন্য বা চিরস্মরণীয় রাজনীতিক ভারতে খুব কম জন্মাননি। কিন্তু দলমত নির্বিশেষে এক জন রাজনীতিক জনপ্রিয়, এমনটা কমই দেখা গিয়েছে। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় যে সেই মুষ্টিমেয়দের এক জন, তা নিয়ে কারও কোনও সংশয় থাকার কথা নয়। কিন্তু যে দলটায় সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন, সেই দলটা তাঁর মূল্যায়ণ আদৌ করতে পেরেছিল কি না, তা নিয়ে সংশয় অনেকেরই। সোমনাথকে বহিষ্কারের দিনেও সিপিএম দিকভ্রষ্ট ছিল। সোমনাথের প্রয়াণেও সে দল একই রকম দিকভ্রষ্ট।

Advertisement

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে ভোটে হারিয়ে যাঁর রাজনৈতিক উত্থান শুরু, সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শোকপ্রকাশ করলেন মৃত্যু সংবাদ পাওয়া মাত্রই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী শোক ব্যক্ত করলেন। রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ শোকবার্তা প্রকাশ করলেন। শোকবার্তা এল গোটা দেশ থেকে। কিন্তু সারা জীবন যে দলটা ছাড়া অন্য কোথাও নাম লেখানোর কথা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় ভাবতেই পারেননি, সেই সিপিএম শোক প্রকাশের ব্যাপারে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে কাতর হয়ে পড়ল। সকাল ৮টা ১৫ নাগাদ প্রয়াত হয়েছিলেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। দুপুর ১টা ৩ মিনিটে টুইট করে শোক জ্ঞাপন করলেন সিপিএম সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। দুপুর ১টা ১৪ মিনিটে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সিপিএম টুইট করে জানাল যে, দল শোকাহত। দুপুর ১টা ৩৩ মিনিটে টুইট করল সিপিএম পলিটব্যুরো, জানানো হল শোক। কোনও টুইটেই সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে এক কালের সহযোদ্ধা হিসেবে উল্লেখ করা হল না। ইয়েচুরির টুইট বা দলের টুইট, দু’টিতেই সোমনাথকে শুধু দশ বারের সাংসদ এবং প্রাক্তন স্পিকার বলে আখ্যায়িত করা হল। মৃত্যু সংবাদ পাওয়া মাত্রই বাংলার সিপিএম নেতাদের প্রায় সকলেরই বোধহয় পৌঁছে যাওয়া উচিত ছিল হাসপাতালে। পৌঁছলেন মাত্র কয়েক জন। গণশক্তির বাংলা ওয়েবসাইটে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে যদিবা ‘কমরেড’ বলে উল্লেখ করা হল, গণশক্তির ইংরেজি ওয়েবসাইটে সে সম্বোধন উধাও হয়ে গেল।

আরও পড়ুন: লড়াই থামল, সোমনাথের শেষযাত্রা লাল পতাকা ছাড়াই

ক্ষুদ্রতা, সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারলে কি এই রকম একটা ছবি তৈরি হত? ক্ষুদ্রতা কাটিয়ে ওঠা গেল না বলেই ইয়েচুরি বা পলিটব্যুরো বা রাজ্য কমিটির টুইটের আগে শোকজ্ঞাপন করে ফেলল গোটা দেশ। ক্ষুদ্রতা কাটিয়ে ওঠা গেল না বলেই সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে দীর্ঘ দিনের সহযোদ্ধা বলে উল্লেখ করা গেল না শোক বার্তায়। ক্ষুদ্রতা কাটিয়ে ওঠা গেল না বলেই দলীয় মুখপত্রের বাংলা ওয়েবসাইটে ‘কমরেড’ লিখেও ইংরেজি ওয়বসাইটে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যু সংবাদের হেডলাইন থেকে ‘কমরেড’ শব্দ সরিয়ে রাখতে হল।

আরও পড়ুন: বিমানকে দেখে ফুঁসে উঠলেন ছেলে, মেয়ে মুগ্ধ মমতায়

আরও পড়ুন: সওয়া পাঁচ ঘণ্টা পর নড়ল পলিটব্যুরো, অনড় শুধু কারাট

ক্ষুদ্রতা, সঙ্কীর্ণতা, মধ্য মেধার এই সাধনা আর কত দিন? বার বার মুখ পুড়ছে, বার বার অস্বস্তি ঘিরে ধরছে, বার বার সমালোচনার শিকার হতে হচ্ছে। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মরদেহে দলীয় পতাকাটাও রাখতে দিতে রাজি হলেন না তাঁর পরিজনরা। রাজ্য সিপিএমের একেবারে সামনের সারির কোনও কোনও মুখকে বাড়িতে ঢুকতে দিতে রাজি হলেন না সোমনাথ চট্টাপাধ্যায়ের পরিজনরা। এই পরিস্থিতিটা কেন তৈরি হল? এই প্রত্যাখ্যান কেন প্রাপ্য ছিল সিপিএমের? এখনও কি এক বার ভেবে দেখবেন সিপিএম নেতারা?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন