মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বেজিংয়ে গিয়া চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিংকে একটি দুর্মূল্য উপহার দিয়া আসিলেন— স্বপ্নসম কূটনৈতিক জয়। এই মুহূর্তে শি-র কট্টর সমর্থকরা আনন্দে ভাসমান, চিনা সংবাদমাধ্যম জাতীয় গর্বে আটখানা, এবং প্রায় তীর্থদর্শন ও পূজানিবেদনের মতো ট্রাম্পের বেজিং সফরে বাহিরের বিশ্ব চমৎকৃত। তিনি কেবল শি-কে ‘সম্ভবত এ-যাবৎ চিনের সর্বাধিক শক্তিমান’ নেতা অভিধাই দেন নাই, যে দাবি চিন বেশ কিছু কাল ধরিয়া করিয়া আসিতেছে, এবং পৃথিবীর বহু দেশ যাহা আশঙ্কা করিতেছে, চিনের সেই বিশ্বনেতৃত্বের আকাঙ্ক্ষাও যেন ট্রাম্প অতি প্রসন্নমনে মানিয়া লইলেন। এমনকী উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে যেন শি চিনফিং আরও ‘প্রো-অ্যাকটিভ’ বা স্বতঃসক্রিয় ভূমিকা লন, এই অনুরোধও করিলেন। কোরিয়া লইয়া চিনের অবস্থান ও সমস্যা কাহারও অজানা নাই। যাহা লক্ষণীয়, চিন-আমেরিকার মধ্যে সচরাচর অনুক্ত ও অনালোচিত এই ক্ষেত্রটি লইয়াও ট্রাম্প বিন্দুমাত্র দ্বিধা দেখাইলেন না। বেজিংকে মৌখিক ভাবেও ওয়াশিংটন ‘আপার-হ্যান্ড’ দিতেছে, ইহা কেবল বিরল নহে, ঐতিহাসিক বলা যায়। চিনা সংবাদমাধ্যম অভ্যাসগত ভাবে আবেগবর্জিত এবং নিম্নতারে বাঁধা, এ বার কিন্তু তাহাদের উদ্দীপনা আর বাঁধ মানিতেছে না। বিপরীতে, মার্কিন সংবাদমাধ্যমের এক বিরাট অংশ স্পষ্ট ঘোষণা করিয়াছে, ইহা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এ যাবৎ কালের সর্বাপেক্ষা বড় কূটনৈতিক ভুল।
কতকগুলি গুরুতর অর্থনৈতিক বিষয়ে মার্কিন ও চিনা স্বার্থের সরাসরি সংঘাত চিরকালই ছিল, চিরকালই মার্কিন প্রেসিডেন্টরা তাহা দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় উত্থাপন করিয়া থাকিয়াছেন। বস্তুত, কেবল উত্থাপন নহে, তাহার উপর অনেকখানি জোর দিয়াছেন। অথচ ট্রাম্প বাণিজ্যিক সম্পর্ক লইয়া খানিক আগাইলেও মার্কিন কোম্পানিগুলির চিনে ব্যবসা করিবার সম্ভাবনা বিষয়ে কোনও কথা বলিলেন না। ভাবটা এমন, ইহা কোনও বড় ব্যাপারই নয়, আলোচনার টেবিলে উঠিবার যোগ্য নয়। মজার ব্যাপার, নির্বাচনী প্রার্থীরূপে ট্রাম্প কিন্তু মার্কিন অর্থনীতির ‘সর্বনাশ’-এর হেতু হিসাবে চিনকে গোড়ার পাপী ঠাহরিয়াছিলেন। বৎসর ঘুরিয়া গিয়াছে, মার্কিন দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির চালটিও কিছু পাল্টাইতেছে। এখন তাঁহার এই ক্ষমাসুন্দরতার পিছনে সেই সব হিসাব অনুপস্থিত, এমনটা বলা যাইবে না। তবে ট্রাম্পের উক্তির পিছনে চিন্তাভাবনার ভূমিকা কতখানি, সেই গূঢ় প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর নাই, থাকিবে বলিয়া ভরসাও নাই।
দেশ ছাড়িবার আগে আর একটি বিষয়ে ট্রাম্পকে উপদেশ দিয়াছিলেন তাঁহার সমালোচকরা, এমনকী তাঁহার সমর্থকরা ও রিপাবলিকান পার্টির সহকর্মীরাও। মানবাধিকার দলনের যে নূতন রেকর্ড চিনে স্থাপিত হইতেছে, সে বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের অন্তত কিছু বাক্য খরচ করা অত্যন্ত জরুরি: সর্বদলীয় মত ছিল। বিশেষত সম্প্রতি নোবেল পুরস্কারপ্রাপক লিউ জিয়াওবোর অন্তরিন অবস্থায় মৃত্যুর পর এই নৈতিক ভর্ৎসনা বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের কাছে কেবল প্রত্যাশিত ছিল না, আবশ্যক ছিল। কিন্তু না, একটি শব্দও এ বিষয়ে উচ্চারিত হয় নাই। তাবৎ চিনা রাজনীতি-মহল হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিয়াছে। পরিবেশরক্ষার ক্ষেত্রে আবার দেখা গেল বিপরীত ঘটনা। বিশ্ব পরিবেশ চুক্তি হইতে ট্রাম্পের সাম্প্রতিক প্রত্যাহার লইয়া চিন অপ্রসন্ন হইলেও সেই অপ্রিয় প্রসঙ্গ উঠিল না। কূটনীতি যেমনই হউক, বোঝাপড়াটি তবে ভালই হইয়াছে। সেটুকু কৃতিত্ব ট্রাম্পকে দিতেই হইবে। তিনি মার্কিনিদের মার্কিন স্বার্থ দেখিবেন, আর শি বিশ্বপৃথিবীর ভার লইবেন: হয়তো ইহাই তাঁহার নূতন কূটনীতির চাল! শি চিনফিং তাহাতে আহ্লাদিত হইবেন, স্বাভাবিক। কিন্তু গণতান্ত্রিক নীতি ও আদর্শের পক্ষে ইহা সুখের সময় নহে।