টানিতে টানিতে

উৎসবপ্রিয় মুখ্যমন্ত্রীর সাগ্রহ সহযোগিতায় সপ্তাহ যদি ক্রমে পক্ষে প্রসারিত হয়, বিস্ময়ের কিছু নাই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০১৮ ০০:৩৯
Share:

পঞ্জিকায় এখনও দুর্গাপূজা চার দিনের, বোধনের ষষ্ঠী যোগ করিলে পাঁচ। কিন্তু বাঙালি তাহাকে টানিতে টানিতে এক সপ্তাহ পার করাইয়া দিয়াছে। উৎসবপ্রিয় মুখ্যমন্ত্রীর সাগ্রহ সহযোগিতায় সপ্তাহ যদি ক্রমে পক্ষে প্রসারিত হয়, বিস্ময়ের কিছু নাই। অনন্তের পথে শারদোৎসবের এই রবার-ব্যান্ড-সুলভ বিস্তারের ছবিখানি দিব্যদৃষ্টিতে দেখিয়াই বোধ করি বাঙালির কবি গাহিয়াছিলেন: শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে। দোষ দিবার অবশ্য কিছু নাই, আপনার রবার-ব্যান্ড আপনি টানিলে কাহার কী! শুধু দুর্গাপূজা টানিয়া সন্তুষ্ট হইলেই বা চলিবে কেন, বাঙালির ভাণ্ডারে বারো মাসে তেরো পার্বণ কি অহেতুক নাকি? প্রতিটি পার্বণকে টানিয়া লম্বা করিতে হইবে, যথা কালীপূজা অন্তত চার দিন, সরস্বতী নিদেনপক্ষে তিন। টানিবার আরও নানা বুদ্ধি আছে। যেমন, যে সকল পূজা এত কাল রাজ্যের কিছু এলাকায় সীমিত ছিল, তাহাকে রাজ্য জুড়িয়া প্রসারিত করা। এই বুদ্ধিতেই জগদ্ধাত্রী দেখিতে দেখিতে কলিকাতায় নূতন নূতন ঠিকানা সংগ্রহ করিতেছেন। আবার, যে সকল দেবদেবীর পূজা রাজ্যে ছিল না বলিলেই চলে, তাঁহারাও দাপটের সহিত সাম্রাজ্য বিস্তার করিতেছেন। উদাহরণ হিসাবে সিদ্ধিদাতা গণেশের নাম বলিতে পারিবার জন্য কোনও পুরস্কার নাই। তাঁহার পিছু পিছু বজরংবলীও আসিতেছেন, তাঁহার হুঙ্কার এক শিবির হইতে অন্য শিবিরে প্রতিধ্বনিত হইতেছে। উর্বর বঙ্গভূমিতে শস্যের বীজ বুনিলে সোনা ফলে, তাহা জানা ছিল। দেবপূজার চাষও যে এমন উচ্চফলনশীল, সেই সত্যটি জানা ছিল না।

Advertisement

বস্তুত, ইহা ফাঁকিবাজির চাষ। আলস্যের চাষ। যে আলস্য কাজ না করিয়া সময় কাটাইয়া দিবার প্ররোচনা দেয়। যে ফাঁকি নিজেকে আনন্দের মুখোশ পরাইয়া প্রলোভন দেখায়। সে মন্ত্রণা দেয়— কাল যাহা করিলে চলে, আজ তাহা করিবার দরকার কী? এই মন্ত্রণা যে কেবল পূজা বা উৎসবের সময়েই শোনা যায়, তাহা নহে। বাঙালির অন্তরে অন্তরে তাহা সংবৎসর অনুক্ষণ বাজিয়া চলে। কিন্তু চক্ষুলজ্জার এক ছটাক সম্ভবত এখনও অবশিষ্ট আছে, তাই কাজ না করিয়া ফাঁকির হাওয়ায় গা ভাসাইতে ঈষৎ বিবেকদংশন হয়। সেখানেই উৎসবের আশ্চর্য ক্ষমতা। তাহার নামে সব দোষ কাটিয়া যায়, বাঙালি বুক ফুলাইয়া বলিতে পারে: বচ্ছরকার দিনটিতে আনন্দ করিব না! বচ্ছরকার দিনটির সংখ্যা যে তিন শত পঁয়ষট্টি ছুঁইতে চলিল, সে কথা গলা নামাইয়া বলিতে আজ্ঞা হউক, সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরও তো সব কথা উচ্চকণ্ঠে বলেন নাই। এবং, দুর্গাপূজার মাহাত্ম্য এমনই যে, গলা নামাইবারও প্রয়োজন হয় না, বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবের আনন্দে বাগড়া দিবে, এমন পাষণ্ড কে আছে? সুতরাং আশ্বিনের শারদপ্রাতে আদাজল খাইয়া পূজার আনন্দ উপভোগ করিবার মহোল্লাসে বাঙালি আপন কব্জি ডুবাইতে অধীর। কব্জির সহিত তাহার সকলই ডুবিতে বসিয়াছে, ফাঁকি দিতে দিতে সে নিজেই বিষম ফাঁকিতে পড়িয়াছে, কর্মহীনতার মহাতীর্থ হিসাবে ভূভারতে তাহার খ্যাতি সুপ্রতিষ্ঠিত, এবং তাহার পরিণামে ভূভারতে কেহ আর তাহাকে কোনও বিষয়েই গণ্য করে না, সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে হালভাঙা পালছেঁড়া বাঙালি সর্ব বিষয়েই পিছন দিকে দুর্বার গতিতে আগাইয়া চলিয়াছে। কিন্তু এই সকল কথা বলিয়া লাভ নাই। এখন দুর্গোৎসব। এখন বাঙালি আপন রবার-ব্যান্ড টানিবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন