জল (<সংস্কৃত জল) নাকি পানি (<সংস্কৃত পানীয়)? সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে প্রবল তর্ক। এক দল বলছেন, জল বাংলা শব্দ, পানি মোটেও বাংলা নয়, আরবি বা ফারসি, এবং পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা তা ব্যবহার করে না। আর এক দল ঝাঁপিয়ে পড়ে পানির বাঙালিত্ব প্রতিষ্ঠার তোড়জোড় করছেন। এই আক্রমণ ও প্রতি-আক্রমণ সময় সময় শালীনতার সীমা লঙ্ঘন করছে এবং হাস্যকর ও ভয়ংকর কিছু ভুলভাল তথ্য ও মন্তব্যে ভরে উঠছে অান্তর্জাল। এর মধ্যে সাম্প্রতিক গৈরিক বা সবজে ট্রেন্ড-ও যে সুপ্ত নেই, একটু চোখকান খোলা রাখলেই মালুম হবে। এ সব দেখে লালনের ভাষায় বলতে ইচ্ছে করে, ‘জলের উপর পানি না পানির উপর জল?’ কবি, চলচ্চিত্র পরিচালক মাসুদ পথিক ‘জল ও পানি’ কবিতায় এই প্রশ্নটিই উসকে দেন, ‘মনে মনে ভাবি, এই কান্নায় কি ঝরে বেশি জল না পানি?’ সোহেল রানা বয়াতি এই কবিতা অবলম্বনে তাঁর সমনামের শর্ট ফিল্মে পরদাবন্দি করেন জল ও পানির দ্বন্দ্ব বিষয়ক অমোঘ সব প্রশ্ন। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের সদস্য নবীন ভারতীয় ভাষাগুলি দিব্যি ‘পানি’ ব্যবহার করে (হিন্দি, ওডিয়া, বাংলা, গুজরাতি, মরাঠি, অসমিয়া ইত্যাদি)। কিন্তু এই জল ও পানি নিয়ে ছুঁতমার্গ ঠিক কবে থেকে শুরু হল বাংলায়? বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদে দেখি, ‘তেন ন চ্ছুপই হরিণা পিবই ন পাণী।’ (ভুসুকপা)। বড়ু চণ্ডীদাস শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন-এ এই দুই শব্দ পাশাপাশি ব্যবহার করেন, ‘তোহ্মার বোলে কেহো কাহ্নাঞি না বহিব পাণী।/ উচিত নিফল হৈব তোর জল ভাবি বুঝ চক্রপাণী।।’ (যমুনাখণ্ড)
তিনি অজস্র বার পাণী (বা পাণি) ব্যবহার করেছেন জল, পানীয় বা বৃষ্টির প্রতিশব্দ হিসাবে (এখনও মুর্শিদাবাদের মুসলমান জনগোষ্ঠীর কথায় পানি=বৃষ্টি। ‘রোদ হ’চে পানি হ’চে/ খ্যাক শিয়ালের বিহে হ’চে’।)। মধ্যযুগের কবিরা অবলীলায় চয়ন করছেন এই দুটি শব্দ। চণ্ডীমঙ্গলে পাচ্ছি, ‘বিরহ-জ্বরে পতি যদি মরে/ কোন ঘাটে খাবে পাণী/ কাঁখে হেমঝারি মেনকা সুন্দরী/ জল সাধে ঘরে ঘরে’ (কবিকঙ্কণ)। চৈতন্যমঙ্গলে, ‘এ বোল শুনিয়া পুনঃ প্রভু বিশ্বম্ভর। কান্দয়ে দ্বিগুণ ঝরে নয়নের জল।।’ এবং ‘মুখে নাহি সরে বানী/ দু নয়নে ঝরে পানি...’ (লোচনদাস)। এমনকী সৈয়দ আলাওল, যাঁকে আপামর বাঙালি ‘মুসলমান কবি’ হিসাবেই চেনে, তিনিও ‘জল’ ব্যবহার করছেন। ‘শীর্ষের সিন্দুর নয়ানের কাজল/ সব ভাসি গেল জলে।’ বা ‘না ভিজয় জলেত অগ্নিত না পোড়য়’ (পদ্মাবতী)। খনার বচনে এই দুটি শব্দেরই ব্যবহার আছে, ‘খনা বলে শুন হে স্বামী/ শ্রাবণ ভাদরে হবে না পানি’ এবং ‘রান্ধি বাড়ি যেবা নারী পুরুষের আগে খায়/ ভরা কলসীর জল তার তরাসে শুকায়।।’ অন্য দিকে লোকসাহিত্য যখন যেটা জুতসই মনে করেছে, তখন সেটা ব্যবহার করেছে। ‘থির পানী পাথর সয়’ এবং ‘জলেই জল বাধে’; ‘হাতি ঘোড়া গেল তল/ মশা বলে কত জল’; ‘ধরি মাছ, না ছুঁই পানি’; ‘জানি কাজ পানি’; ‘ধন জন জোয়ানী/ কচু পাতার পানি’। এখনকার সাহিত্যিককুল দুটি শব্দই ব্যবহার করেন ঠিকই, কিন্তু কোন শব্দটি বেশি ব্যবহার করছেন তা তাঁর বেড়ে ওঠার চর্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত অবশ্যই।
এখন ধরা যাক, এক দল চাইছে শুধু জল শব্দটি, আর এক দল পানি। তা হলে এই দুই শব্দজাত অন্যান্য শব্দগুলির কী দশা হবে? জলপানি (বৃত্তি) কী দাঁড়াবে? জলজল বা পানিপানি? জলখাবার হয়ে যাবে পানিখাবার? জলপাই হবে পানিপাই, জলবায়ু হবে পানিবায়ু, আদাজল দাঁড়াবে আদাপানি-তে? আরও কতকগুলো শব্দের হদিশ নেওয়া যাক। জলচল (পানিচল?), জলজ (পদ্ম। পানিজ?), জোলো (??), জলীয় (পানীয়? সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ), পানিফল (জলফল? যদিও সংস্কৃতে শব্দটি আছে কিন্তু বাংলা ভাষা শব্দটি গ্রহণ করেনি), পানতা (<পানিতা<পানি+তা। জলতা?), পানকৌড়ি (পানি(নী)+কৌড়ি(ড়ী); জলকৌড়ি?), পানসে (<পানসা<পানিভাসা। জলসা/সে?), পানা (<পানি+আ। সরবত, জলের উদ্ভিদ। জলা/জালা?)
যে কোনও ভাষা কোনও শব্দ গ্রহণ করবে নাকি করবে না, তার নিয়মকানুন আছে। বাংলায় ‘জল’ বা ‘পানি’র বহু প্রতিশব্দ থাকা সত্ত্বেও দুটি শব্দই প্রচলিত। শুনেছি বিখ্যাত এ-পার বাংলার লেখকদের লেখা থেকে ‘জল’ কেটে ‘পানি’ বসিয়ে বই পাইরেসি হয় ও-পার বাংলায়। এ-পারে প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ে দাদি, নানি, ফুপু শব্দ যোগ হওয়াতে হইহই হয়। কিন্তু কাদের সন্ততিরা পড়ে এই সব স্কুলে? যাঁরা দাদি, নানি, ফুপু শব্দগুলি ব্যবহার করেন, তাঁদের সন্তানরাই এই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটা বড় অংশ। গবেষকরা দেখিয়েছেন, বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠী হিন্দু জনগোষ্ঠীর একেবারে নীচের তলার বাসিন্দা ছিল (ক’জনই বা বিদেশি মুসলিম এসেছিলেন আর থেকে গিয়েছিলেন বাংলায়?)। তাঁদের ওপর জাতপাত-সংক্রান্ত অত্যাচারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ইঙ্গিত পাওয়া যায়। অন্য দিকে, ক্ষমতায় থাকা মুসলিমরাও প্রজাদের খুব আদর-যত্নে রাখতেন বলে মনে হয় না। গোপাল হালদার ব্যাখ্যা করেছেন, ক্ষমতা ও সংস্কৃতির শীর্ষে থাকা মুসলিমরা আরবি, ফারসিতে লেখাপড়া বা সাহিত্যচর্চা করেছেন। অন্য দিকে নিচুতলার মুসলিমরাই মৌখিক সাহিত্য (যেহেতু তাঁরা ইশকুল অবধি পৌঁছতে পারেননি)এবং পরে কিছু কিছু লিখিত সাহিত্যের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষায় অবদান রেখেছেন (বাঙালী সংস্কৃতির রূপ)। মধ্যযুগের সব কবিরাই যখন জল ও পানি ব্যবহার করছেন, তখন কি সিদ্ধান্ত করা যায় ঔপনিবেশিক বাংলা এই বিভাজনের ভিত সৃষ্টি করেছিল? সিপাহি বিদ্রোহের বন্দুকের টোটা, ভারত ভাগ, বঙ্গভঙ্গ, মন্বন্তর, জাতপাত, দাঙ্গায় লুকিয়ে আছে এর বীজ? জোর করে কোনও শব্দ চালু করতে চাইলেও ভাষার নিজের মরজি বাতিল করবে অবাঞ্ছিত শব্দ। আর যে শব্দ প্রচলিত তাকে বাদ দেওয়াও সহজ হবে না, এমনকী কালের নিয়মে একটি শব্দের অর্থ পরিবর্তিত হয়ে গেলেও। শব্দের গৈরিকীকরণ বা সবজেকরণ তাই বরদাস্ত করবে না বাংলা ভাষা।