গুড় দিয়েই যদি শত্রুকে বন্ধু করা যায়, বিষ দিয়ে কী লাভ?

আক্রমণ এলেও পাল্টা আক্রমণ করে শত্রুদের সঙ্গে একাসনে বসতে চাননি নরেন্দ্র মোদী। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষালকেমন আছেন নরেন্দ্র মোদী? চারিদিক থেকে এখন নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে গোলাবর্ষণ চলছে। দিল্লিতে বহু বছর সাংবাদিকতা করার দৌলতে আর এ দেশের চূড়ান্ত রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার ফলে বহু প্রধানমন্ত্রীকে দেখেছি এই শাহি দিল্লিতে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:২০
Share:

প্রতীকী ছবি।

কেমন আছেন নরেন্দ্র মোদী? চারিদিক থেকে এখন নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে গোলাবর্ষণ চলছে। দিল্লিতে বহু বছর সাংবাদিকতা করার দৌলতে আর এ দেশের চূড়ান্ত রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার ফলে বহু প্রধানমন্ত্রীকে দেখেছি এই শাহি দিল্লিতে। আড়াই বছর অতিবাহিত হলেই সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের অসন্তোষ বাড়বে। এটাই প্রকৃতির সূত্র। এক জন রাষ্ট্রনায়ক আসেন আবার তিনি চলেও যান। আবার আসেন নতুন কোনও ব্যক্তিত্ব। ফজলি আম ফুরোলে ফজলিতর আম আর হয় না, আম ফুরোলে বাজার থেকে নতুন আতা আনতে হয়। যে ভাবে নিবারণ চক্রবর্তীর নাম সাহিত্য সভায় খোলা হাটে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন অমিত রায়। নরেন্দ্র মোদীর ক্ষেত্রেও এই রাজনৈতিক অনক্রম্যতা বা অ্যানাক্রনিজম হবে এমনটা ভাবব কেন?

Advertisement

তবে ব্যতিক্রম হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে জ্যোতি বসুর ক্ষেত্রে। দীর্ঘ দিন ধরে জ্যোতিবাবু এই অসন্তোষের মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেটাও সম্ভব হয়েছিল ঠিক তত দিন যত দিন জ্যোতিবাবুর বিরুদ্ধে কোনও বিকল্প রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ গড়ে ওঠেনি।

নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে অসন্তোষের প্রক্রিয়া শুরু হলেও এখনও মোদী বিরোধী ঠিকানা হিসাবে কোন শক্তিকেই সেই পরিসর দেওয়ার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে হয় না। সে দিন মোদী ঘনিষ্ঠ এক শীর্ষ বিজেপি নেতার সঙ্গে আড্ডা হচ্ছিল। নিরামিষ মধ্যাহ্নভোজন করছিলাম সেই নেতাটির সঙ্গে। তা সে ভদ্রলোক বললেন, একটা কথা আছে, ছোটবেলায় আমার মা আমাকে বলতেন, যদি গুড় দিয়েই এক জন শত্রুকে বন্ধু বানিয়ে ফেলা যায় তবে তাকে বিষ দিয়ে মেরে ফেলে লাভ কী?

Advertisement

ওই নেতাটি বলেছিলেন, মোদীজির বুদ্ধি অসামান্য। দেখুন দলের ভিতর কারা কারা তাঁর বিরোধিতা করেছিলেন। বসুন্ধরা রাজে, উমা ভারতী থেকে গোয়ার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মনোহর পর্রীকর পর্যন্ত মোদী সম্পর্কে প্রকাশ্যে কটু মন্তব্য করেছিলেন। উমা ভারতী তো মোদীকে ভস্মাসুর বলেছিলেন। স্মৃতি ইরানি? মনে আছে স্মৃতি কী ভাবে প্রকাশ্যে মোদীকে আক্রমণ করেছিলেন? মোদী নিজে কিন্তু কখনওই ওঁদের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণে যাননি। তিনি যদি ওঁদের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ হানতেন তা হলে তিনি ওঁদের সঙ্গে একই পঙক্তিতে বসতেন। যাকে বলে সমান-সমান, সেটাই হয়ে যেতেন। ওই নেতাটির স্টকে অনেক লোকায়ত হিন্দি বলয়ের প্রবচন। তিনি বললেন, গ্রামে আর একটা কথা চালু আছে, গালি যদি কেউ তোমায় দেয় তাতে তো মাথায় আঘাত লেগে ফুলে যায় না। কোনও কাটাকাটি নেই। কেউ যদি তোমাকে গালি দেয় তবে তুমি সেটাকে ইগনোর করো, সেটাই ভাল। ক্রিয়া কর, প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন কোর না। Only Act Don’t react. নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে।

সে দিন সেই উমা ভারতীর সঙ্গে দেখা হল। বললাম, একদা আপনি কী না বলেছেন, তখন তো আপনি অগ্নিকন্যা ছিলেন। উমার এখন হাঁটুতে ব্যথা। শরীরটা আজকাল ভাল যাচ্ছে না। শুধু হাঁটুর বেদনার জন্য ইজরায়েল সফর পর্যন্ত বাতিল করতে হয়েছে। তা এই উমা ভারতী বললেন, আগে তো আমি ফায়ার ব্র্যান্ড নেত্রী ছিলাম, নরেন্দ্র মোদী আমাকে এখন ওয়াটার ব্র্যান্ড নেত্রী করে দিয়েছেন। এখন উমা জলসম্পদ মন্ত্রী। গঙ্গাকে পরিবহণ করাই এখন তাঁর লক্ষ। স্মৃতি ইরানির কথা তো ছেড়েই দিলাম। আর প্রতিরক্ষামন্ত্রী তো এখন মোদীর খুবই ঘনিষ্ঠ। ঠান্ডা মাথায় মোদী দলের ভিতরের প্রতিপক্ষকেও বিষ দিয়ে নয়, গুড় দিয়েই বশ্যতা স্বীকার করিয়ে অনুগামীতে পরিণত করেছেন।

আবার বিরোধী শিবিরের দিকে তাকান। রাহুল গাঁধা মোদী-বিরোধী একটা রাজনৈতিক মঞ্চ গড়ে তুলতে চাইছেন। কিন্তু সে কাজে তিনি আংশিক ভাবে সফল হয়েছেন। সেটা হল উত্তরপ্রদেশে অখিলেশ যাদবের সঙ্গে বোঝাপড়া করলেও কিন্তু গোটা দেশের অ-বিজেপি বিরোধী সমস্ত রাজনৈতিক দল যে রাহুল গাঁধীর ছাতার তলায় এসে গেছেন এমন নয়। বিহারে লালুর সঙ্গে বোঝাপড়ার ফলে রাহুল বিজেপি-বিরোধী জোট গঠনে সফল হয়েছিলেন, তার ফলও ভাল হয়। বিহারের জোটের ভাল ফল পাওয়ায় রাহুল গাঁধী আরও সক্রিয় হয়েছেন। সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু মোদী ২০১৯ সালে পরাস্ত হবেন এবং কংগ্রেস বা বিরোধী শিবির ক্ষমতাসীন হবেন এমনটা এখনও কেউ মনে করতে পারছেন না।

আবার মোদী নিজে লালুপ্রসাদ যাদব, নবীন পট্টনায়েক, মায়াবতী-মুলায়ম-শরদ পওয়ার প্রমুখ নেতার সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছেন। আজ নয়, বিগত লোকসভা নির্বাচনের আগেও আমি দেখতাম মোদীর সঙ্গে পওয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করে চলতেন। মোদী তো মুম্বই গেলে প্রায়ই শরদ পওয়ারের সঙ্গে দেখা করতেন। কাজেই আজও নরেন্দ্র মোদীর সেই রাজনৈতিক কৌশল অব্যাহত। সিবিআই-এর তদন্তের কথা তো ছেড়েই দিলাম। শশীকলা-মায়াবতী থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রত্যেকের বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্ত করার রণকৌশল তো আর একটা দিক। গত আড়াই বছরে সিবিআইয়ের সেই ভূমিকাটিও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।

আরও পড়ুন:

লোকসভায় মুখ খুলেও মোদী যেন জৌলুসহীন

শশিকলার সঙ্গে শতাধিক বিধায়ক, তবু আস্থাভোটের পথেই হাঁটছেন পনীর

ইন্দিরা কংগ্রেসের ভিতর সিন্ডিকেট বা বৃদ্ধতন্ত্র ক্ষুব্ধ নেতাদের মোকাবিলা করেন আর প্রমাণ করেন তিনিই আসলে কংগ্রেস। দল ভেঙেও ইন্দিরা নিজেই নিজের নেতৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করেন। দলের মধ্যে মোদী নিজের কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করেছেন— দল না ভেঙেই গোটা দেশের মানুষের সমর্থন নিয়ে। আজ দলের বাইরে যে মোদী-বিরোধী আক্রমণ, প্রতিনিয়ত মোদী তারও মোকাবিলা করছেন।

উত্তরপ্রদেশের জনসভায় দাঁড়িয়ে মোদী বলছেন, মোদী সে নারাজ তো হোগাই! চোর আর লুটেরাদের মোদী শেষ করছে, তাই ৭০ বছর ধরে যারা পাপ করছে তারাই মোদীকে শেষ করতে চাইছে। মোদীর এই টিকে থাকার রাজনীতির কৌশল অনবদ্য। এই কৌশলের সাফল্যে প্রথম ধাক্কা লাগতে পারে যদি উত্তরপ্রদেশের ভোটের ফলাফলে বিজেপি ধাক্কা খায় এবং অখিলেশ-রাহুল জোট ভোটে জয়লাভ করে।

সে প্রশ্নের জবাব পেতে আমাদের আপাতত আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।

(এখন থেকে ‘শাহি সমাচার’ বুধবারের পরিবর্তে প্রতি বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হবে।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন