সম্পাদকীয় ২

অরণ্যের অধিকার

নেতা দায়িত্ব লইলেন, এবং দায়িত্ব লইয়া আমাজনে আগুন লাগাইলেন— ঈর্ষান্ধ নিন্দকের কথা বলিয়া মনে হইতে পারে। বাস্তব কিন্তু বোলসোনারোর বিরুদ্ধেই সাক্ষ্য দিতেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৯ ০০:০১
Share:

ছবি এপি।

রোম যখন পুড়িতেছিল, সম্রাট নিরো নাকি বেহালা বাজাইতেছিলেন। এখন আমাজন অরণ্য পুড়িতেছে, আর ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনারো কমেডি শো দেখিতেছেন। ঘটমান ট্র্যাজেডির দিকে তাঁহার নজর নিশ্চিত ভাবেই আছে, কিন্তু মন নাই। তিন সপ্তাহের অধিক কাল যাবৎ অগ্নিদগ্ধ হইতেছে এই গ্রহের বৃহত্তম বৃষ্টি-অরণ্য, যাহার দুই-তৃতীয়াংশই ব্রাজিলে। তথ্যে প্রকাশ, প্রতি মিনিটে পুড়িয়া যাইতেছে তিনটি ফুটবল মাঠের সমান আয়তনের অরণ্য। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম একের পর এক খবর করিতেছে, নানান দেশের নেতা হইতে সাধারণ মানুষ সকলেই উদ্বিগ্ন। ব্রাজিলের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রই তথ্য দিয়াছে, এই বৎসরে অরণ্যে অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত। উল্লেখ্য, বোলসোনারো প্রেসিডেন্ট হইয়াছেন জানুয়ারির গোড়ায়।

Advertisement

নেতা দায়িত্ব লইলেন, এবং দায়িত্ব লইয়া আমাজনে আগুন লাগাইলেন— ঈর্ষান্ধ নিন্দকের কথা বলিয়া মনে হইতে পারে। বাস্তব কিন্তু বোলসোনারোর বিরুদ্ধেই সাক্ষ্য দিতেছে। নির্বাচনী প্রচারে তিনি বলিয়াছিলেন, ক্ষমতায় আসিলে আমাজন-বান্ধব নীতি ও পদক্ষেপগুলি তুলিয়া দিবেন, অরণ্যকে উন্মুক্ত করিয়া দিবেন কাঠুরিয়া, কৃষক ও খামার-মালিকদিগের জন্য। তাহাই হইয়াছে। আমাজনে অগ্নিকাণ্ডের পূর্বে ব্যাপক বৃক্ষনিধন হইয়াছে, পরিবেশবিদরা বলিতেছেন, ২০ শতাংশ অরণ্য এই মুহূর্তে নিশ্চিহ্ন। কৃষকেরা রীতিমতো ‘ফায়ার ডে’ পালন করিয়া জঙ্গলে আগুন লাগাইতেছেন, নেতার অভয়বাণী তাঁহাদের ইন্ধন। ফাঁস হইয়া যাওয়া সরকারি নথি দেখাইয়া দিয়াছে, বোলসোনারো সরকার আমাজনের নদীগুলিকে বাঁধ দিয়া রুদ্ধ করিতে চায়, তাহার লক্ষ্য রাজপথ, সেতু, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ। কৃষিবাণিজ্য ব্রাজিলের অর্থনীতির প্রাণ, তাহার সহিত যুক্ত হইয়াছে শিল্পায়ন। আমাজনে এ যাবৎ বিশালকায় শিল্পসংস্থাগুলি ঢুকিতে পায় নাই, এ ক্ষণে তাহাদের পথ প্রশস্ত।

বোলসোনারোর নীতি বা নীতিহীনতা লইয়া প্রশ্ন তুলিয়াছে আন্তর্জাতিক মহল। জি-৭ সম্মেলনে আমাজন লইয়া আলোচনা করিবার আহ্বান জানাইয়াছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ। আমাজনের আগুন না নিবাইলে ব্রাজিলের সহিত বাণিজ্য সম্পর্ক ছিন্ন করিবে বলিয়া হুমকি দিয়াছে ফ্রান্স, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড। বলিয়াছে, ব্রাজিল হইতে মাংস ও কৃষিপণ্য আমদানি বন্ধ করিবে। ব্রাজিলের সম্পত্তি আমাজন লইয়া অন্য রাষ্ট্রের এত শিরঃপীড়া কেন, প্রশ্ন তুলিয়াছিলেন উদ্ধত বোলসোনারো। উত্তর আসিয়াছে, আমাজন সাধারণ ভূ-রাজনীতির ঊর্ধ্বে, বিশ্ববাসী যে বুক ভরিয়া অক্সিজেন লয় তাহার অনেকটাই এই অরণ্যের দৌলতে। এই অরণ্য অগণিত আদিবাসী ও জনজাতীয় মানুষেরও আবাসস্থল। অরণ্যের অধিকার সর্বাগ্রে তাঁহাদেরই। এক দিকে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ভ্রুকুটি, অন্য দিকে মানবাধিকার ভঙ্গের খড়্গ। চাপের মুখে পড়িয়া বোলসোনারো আগুন নিয়ন্ত্রণে সেনা পাঠাইয়াছেন। ইহাও বুঝিয়াছেন, উন্নয়ন মানেই ক্ষমতার সাহায্যে যথেচ্ছাচার নহে। আমাজনের অনন্য জীববৈচিত্রকে বাঁচাইয়াই শিল্প গড়িতে হইবে। হাতে লইতে হইবে যথোপযুক্ত পরিবেশবান্ধব পুনর্বাসন নীতি। অরণ্যকে গুঁড়াইয়া নহে, তাহার প্রতি শ্রদ্ধানত হইয়াও শিল্পরথ পথ করিয়া লইতে পারে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement