একটি ঘটনা বদলে দিয়েছিল ইতিহাসের অভিমুখ

১৩ এপ্রিল, ১৯১৯। জালিয়ানওয়ালা বাগ। শাসকের হিংসা নেমে এল ভারতের আমজনতার উপরে। শুধু মৃতের সংখ্যাই নয়, ভারতীয় এবং ব্রিটিশ মানসিকতায় ‘দানবীয়’ এই ঘটনার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। একশো বছর পরে ফিরে দেখলেন সৈয়দ তানভীর নাসরীন জালিয়ানওয়ালা বাগই মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীকে কংগ্রেসের অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছিল, এটা যেমন সত্যি, তেমনই এটাও সত্যি দক্ষিণ আফ্রিকা ফেরত গুজরাতি আইনজীবী বুঝে গিয়েছিলেন হিংস্র শাসকের মোকাবিলায় অহিংসা, একমাত্র অহিংসা-ই তাঁকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৯ ০২:৫৯
Share:

দেওয়ালে গুলির চিহ্ন। জালিয়ানওয়ালা বাগ। ছবি: থিঙ্কস্টকের সৌজন্যে

যে কোনও ঘটনার অভিঘাত বুঝতে গেলে, তার প্রতিক্রিয়ায় রাজনীতি বা সমাজে কী প্রভাব পড়েছিল, তা অনুধাবন করতে হয়। জালিয়ানওয়ালা বাগের গণহত্যার ঠিক ১০০ বছর বাদে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের এক জন ছাত্রী হিসেবে যদি আমাকে মূল্যায়ন করতে হয়, তা হলে, বলতেই হবে ১৯১৯-এর ১৩ এপ্রিল আসলে ১৯৪৭ এর ১৫ অগস্টকে নির্ধারিত করে দিয়েছিল। কারণ, ১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহের সময়ও যে শিক্ষিত ভারতীয়েরা ব্রিটিশ শাসকের সঙ্গে সংঘাতের রাস্তায় যাননি, তাঁরাও কিন্তু জালিয়ানওয়ালা বাগের পরে বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে, শাসকের এই হিংস্র রূপের সঙ্গে কোনও রকম সহাবস্থান বা সহযোগিতা সম্ভব নয়। আমি এই কথাটা বলছি, ১৮৫৭-এর সময় কলকাতার তথাকথিত ‘বাবু’রা যে অবস্থান নিয়েছিলেন এবং জালিয়ানওয়ালা বাগের পরে কলকাতা তথা বাংলায় যে ক্ষোভ এবং প্রতিবাদের স্ফুরণ হয়েছিল, তার তুলনা করেই।

Advertisement

জালিয়ানওয়ালা বাগই মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীকে কংগ্রেসের অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছিল, এটা যেমন সত্যি, তেমনই এটাও সত্যি দক্ষিণ আফ্রিকা ফেরত গুজরাতি আইনজীবী বুঝে গিয়েছিলেন হিংস্র শাসকের মোকাবিলায় অহিংসা, একমাত্র অহিংসা-ই তাঁকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারে। কারণ, ১৯১৯-এর ১৩ এপ্রিলের ভয়ঙ্কর ঘটনার জন্য যখন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ারের দিকে অভিযোগের আঙুল উঠেছিল, তখন তাঁর যুক্তি ছিল, এপ্রিলে পঞ্জাবে রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য যে সব হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছিল, তাকেই দমন করতে গিয়ে তিনি ওই ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। হান্টার কমিশনের কাছে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে ডায়ার কবুল করেছিলেন, হয়তো তিনি গুলি না চালিয়েও জালিয়ানওয়ালা বাগে জড়ো হওয়া জনতাকে সরিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি পরিকল্পনা করেই গুলি চালিয়েছিলেন, কারণ, তিনি গোটা পঞ্জাব প্রদেশে ‘বিদ্রোহী’দের একটা শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। অর্থাৎ ‘জালিয়ানওয়ালা বাগের জহ্লাদ’ বলে পরে ইতিহাসে পরিচিত ডায়ার নিজের নৃশংস আচরণ বা হিংসার সমর্থনে যুক্তি হিসেবে এপ্রিলের প্রথম থেকে পঞ্জাবে হওয়া বিভিন্ন বিক্ষোভ, অগ্নিসংযোগ এবং শ্বেতাঙ্গদের উপরে আক্রমণকেই ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন।

ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ বা আন্দোলন যদি হিংসাত্মক চেহারা নেয়, তা হলে, শাসকের হিংসা কী ভাবে ভারতের আমজনতার উপরে নেমে আসতে পারে, জালিয়ানওয়ালা বাগ গাঁধীকে সেই সত্য পরিষ্কার ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিল। ১৯১৯-এর ১৩ এপ্রিল ঠিক কত জন মারা গিয়েছিলেন, সেই নিয়ে বিতর্কে ঢুকে লাভ নেই। প্রত্যক্ষদর্শীরা এবং অমৃতসরের অনেকেই মনে করেন সংখ্যাটা ২০০০-এর কাছাকাছি। কিন্তু ব্রিটিশ ঐতিহাসিকেরা সব সময়ই সংখ্যাটা কমিয়ে দেখাতে চেয়েছেন। ১৯৯৭-এ যখন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ জালিয়ানওয়ালা বাগে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাতে আসেন, সেই সময়ও তাঁর সফরসঙ্গী এবং স্বামী প্রিন্স ফিলিপ ‘মাত্রই কয়েকশো লোক’ মারা গিয়েছিল বলে মন্তব্য করেছিলেন। কারণ, ডায়ারের ‘সুপুত্র’ প্রিন্স ফিলিপের সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এক সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। অতএব ‘জুনিয়র ডায়ার’ তাঁকে যা বলেছিলেন, সেই ‘সত্য’ এবং তথ্যকেই ব্রিটিশ রাজ পরিবারের বর্তমান প্রতিনিধিরাও বিশ্বাস করেন, এটাই ইতিহাসের জন্য দুঃখজনক এবং লজ্জাকরও বটে।

Advertisement

প্রতি বছর জালিয়ানওয়ালা বাগের বর্ষপূর্তির সময়ে ভারতে এবং ব্রিটেনে জোরদার দাবি ওঠে যে, এই গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিক ভাবে ব্রিটিশ সরকারকে ক্ষমা চাইতে হবে। ঠিক যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় করা ‘বাড়াবাড়ি’র জন্য জাপানকে, কোরিয়ার কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছে। এ বছর যখন জালিয়ানওয়ালা বাগের ১০০ বছর পূর্ণ হচ্ছে, তখন সেই দাবি আরও জোরদার। কিন্তু ভারতে নির্বাচন এবং লন্ডন ব্রেক্সিট নিয়ে জেরবার থাকায় হয়তো এ বছরও আমাদের আহত অন্তরাত্মায় প্রলেপ পড়বে না। শুধু আমরা মনে রাখতে পারি, ২০১৩ সালে জালিয়ানওয়ালা বাগে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করতে আসা তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন লিখে গিয়েছিলেন, “ব্রিটিশ ইতিহাসের গভীর লজ্জাজনক ঘটনা। যাকে ঠিক ভাবেই উইনস্টন চার্চিল ‘দানবীয়’ আখ্যা দিয়েছেন। আমরা যেন কখনও না ভুলি এখানে ঠিক কি ঘটেছিল। এবং সেই মনে রাখার মধ্যে দিয়ে আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে ব্রিটেন বিশ্বের সর্বত্র শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ আন্দোলনের অধিকারকে যেন সমর্থন করে।”

২০১৩-তে এসে ডেভিড ক্যামেরন যেটা ব্যক্তিগত ভাবে লিখেছিলেন, সেটা কি ১৯১৯-এর ভয়াবহ গণহত্যার পরে ব্রিটিশ প্রশাসন বা সাদা চামড়ার মানুষেরা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন? ইতিহাসের ছাত্রী হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া ভাল, যদি আমরা ১৯২০-র ৮ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউস অব কমন্স-এ উইনস্টন চার্চিলের বক্তব্য শুনি, তা হলে বিশ্বাস করে নিতে হবে, হ্যাঁ, ব্রিটিশ শাসন নিজেদের ভুলকে উপলব্ধি করতে পেরেছিল। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের যুদ্ধ বিষয়ক সচিব পরিষ্কারই বলেছিলেন, জালিয়ানওয়ালা বাগে যা ঘটেছিল, তা শুধু সে দেশের ইতিহাসের জন্য লজ্জাজনক নয়, দানবীয় এবং ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর। মূলত চার্চিলের বক্তৃতার জন্যই হাউস অব কমন্স-এ সরকারের ডায়ার-বিরোধী প্রস্তাব ২৩০-১২৯ ভোটে জিতে যায় এবং ‘জালিয়ানওয়ালা বাগের জহ্লাদ’কে যে কোনও ধরনের সামরিক দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পাশাপাশি, মনে রাখবেন, হাউস অব কমন্স যখন ডায়ারকে ‘নিন্দা’ করছে এবং তাঁকে সেনাবাহিনী থেকে এক প্রকার বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, ঠিক তখনই রক্ষণশীলেরা কিন্তু হাউস অব লর্ডস-এ ‘জালিয়ানওয়ালা বাগের জল্লাদ’কে প্রশংসা করে প্রস্তাব পাশ করছে।

তা হলে কেন আমি বললাম জালিনওয়ালা বাগ শুধু ভারতের জাতীয় আন্দোলনের চরিত্রকে নির্ধারণ করে দেয়নি, একই সঙ্গে ব্রিটিশরা কী ভাবে তার প্রতি প্রতিক্রিয়া জানাবে, তাও ঠিক হয়ে গিয়েছিল? কারণ, যে রাওলাট আইনকে কেন্দ্র করে সেই সময় গোটা দেশ উত্তপ্ত হয়েছিল এবং পঞ্জাবেও বিক্ষোভ, হরতাল হচ্ছিল, সেই রাওলাট আইন কিন্তু ১৯২০ সালের পরে আর সে ভাবে সামনে এল না, কয়েক বছরের মধ্যেই বাতিল হয়ে গেল। কোনও ঘটনায় গুলি চালানোর ক্ষেত্রেও ব্রিটিশ পুলিশ এবং সেনার ক্ষেত্রে যে ‘সংযত’ ভাব এল, তা দেশ ভাগের সময় এমনকি, দাঙ্গা বিধ্বস্ত পঞ্জাবেও দেখা গিয়েছিল বলে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন।

জালিয়ানওয়ালা বাগের প্রতিক্রিয়ায় রবীন্দ্রনাথ তার ‘নাইটহুড’ ত্যাগ করেন, গাঁধীও ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে পাওয়া বিভিন্ন সম্মান ফিরিয়ে দেন। এই সব কথাই আমরা জানি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর চিঠিতে যেটা লিখেছিলেন, সেটাই বোধহয় জালিয়ানওয়ালা বাগের পরে আহত, দুঃখিত ভারতের অন্তরাত্মার জন্য সবচেয়ে বড় সত্যি ছিল। এর পরে আর ব্রিটিশ শাসনের প্রতি আস্থা রাখার কোনও কারণ সাধারণ ভারতীয়দের কাছে ছিল না। ঠিক সেই কারণেই জালিয়ানওয়ালা বাগের আগে মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার এনে ব্রিটিশ সরকার যে ভারতীয়দের মন জয় করতে চেয়েছিল, তা ব্যর্থ হয়ে যায়। কংগ্রেসও মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কারকে বাতিল করে দিয়ে পূর্ণ স্বরাজের দাবি নিয়ে আন্দোলনে চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়।

বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন