সংবাদকর্মীরা নিজেরাই সংবাদ শিরোনামে আসবেন এটা অভিপ্রেত নয়। এমনতর এক অলিখিত ভাষ্য ভেসে বেড়ায় সংবাদ দুনিয়ায়। তথাপি, খবরওয়ালারাই মাঝে মাঝে খবর হয়ে যান। মারকাটারি সাফল্য বা পুরস্কার পেলে, তেমন কীর্তি রচনা করতে পারলে কিংবা প্রহৃত-আক্রান্ত হলে সাংবাদিক সংবাদপত্রের ভিতরের পাতায় এক কলামে ঠাঁই পান। প্রাণ গেলে প্রথম পাতায় আসেন। এই যেমন শুজাত বুখারি প্রাণের বিনিময়ে প্রথম পাতার খবর হলেন। অনতি অতীতে গৌরী লঙ্কেশ হয়েছিলেন।
ইউনেস্কোর একটি প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ২০১৭ সালে সারা বিশ্বে ৭১ জন সংবাদ কর্মী খুন হয়েছেন বা কাজ করতে গিয়ে আক্রমণে মারা গিয়েছেন। ‘রিপোর্টারস উইদাউট বর্ডার’ সংগঠনের হিসেব অনুযায়ী এখনও পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ৩২৬ জন সংবাদ কর্মী কারারুদ্ধ, ৫৪ জন পণবন্দি, দু’জনের কোনও হদিস নেই। মনে রাখা জরুরি— প্রতিটি আক্রমণ, প্রতিটি প্রাণনাশের কারণ পেশাগত। প্রয়াত সাংবাদিকদের কেউই বাড়ির পাঁচিল নিয়ে ‘ব্যক্তিগত’ ঝামেলায় জড়িয়ে আক্রান্ত হননি বা মারা যাননি। সাংবাদিক বলেই তাঁর প্রাণহানি হয়েছে। ইউনেস্কোর ‘কমিউনিকেশন অ্যান্ড ইনফর্মেশন’ বিভাগের এক কর্তার উক্তি: ‘‘গড়ে প্রতি চার দিনে এক জন সাংবাদিক খুন হন।’’ সদ্য-প্রয়াত শুজাত বুখারিকে ধরলে চলতি বছরেই ভারতে ২৯ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন বা পেশাগত পরিসরে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন। বৎসরান্তে সংখ্যাটা বৃদ্ধি পাবে মাত্র। কিছু সংখ্যক সাংবাদিক নিধন ভিতরের পাতায় যাবে, গুটিকয় প্রথম পাতায় আসবে আর বাকি মৃত্যুগুলি হারিয়ে যাবে, যেমন অনেক মৃত্যু খবর হয় না।
সিরিয়া এবং মেক্সিকো হল ‘ডেডলিয়েস্ট কান্ট্রি ফর রিপোর্টারস’। সাংবাদিকদের পক্ষে সব চেয়ে ভয়ঙ্কর দেশ। এই তালিকায় শুরুর দিকে আছে আফগানিস্তান, ইরাক এবং ফিলিপিন্সও। খুনোখুনি হলেই যে দেশের বাঙালি নেটিজ়েনরা ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ স্টেটাস দিয়ে স্টেটাস বজায় রাখেন, সেই ভারত সাংবাদিকদের পক্ষে কতখানি নিরাপদ? ইউনেস্কোর তথ্য বলছে ২০১০-১৪, এই চার বছরে ভারতে ছাব্বিশ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। ’১১-তে তিন জন, ’১২-তে পাঁচ জন, ’১৩-তে আট জন (ছ’জন উত্তরপ্রদেশে, দু’জন ছত্তীসগঢ়ে), ’১৪-তেও আট জন (উত্তরপ্রদেশে ছয়, বিহারে দুই)। বৃহত্তম গণতন্ত্রে সাংবাদিক হত্যায় ভারত ফার্স্ট বেঞ্চে আসীন, তথ্য সে কথাই বলে।
ইউনেস্কোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত পাঁচ বছরে বিশ্ব জুড়ে সাংবাদিক হত্যার পরিমাণ আশঙ্কাজনক ভাবে বেড়েছে। ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেন্ডস ফর ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন অ্যান্ড মিডিয়া ডেভেলপমেন্ট গ্লোবাল রিপোর্ট ২০১৭/২০১৮’-য় বলা হয়েছে, ২০০৭ থেকে ২০১১-র শেষ পর্যন্ত সিরিয়ায় ৮৬ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। উক্ত সময়ে বিভিন্ন দেশে কত জন সাংবাদিককে খুন করা হয়েছে বন্ধনীতে তার সংখ্যা: ইরাক (৪৬), মেক্সিকো (৩৭), সোমালিয়া (৩৬), পাকিস্তান (৩০), ব্রাজ়িল (২৯), ফিলিপিন্স ও ইয়েমেন (২১), আফগানিস্তান (২০), হন্ডুরাস (১৯), লিবিয়া (১৭), গুয়াতেমালা (১৪), বাংলাদেশ (১০), ইউক্রেন (১০), প্যারাগুয়ে ও তুরস্ক (৬), ফ্রান্স (৪)।
তিন মাস আগে নিজের পত্রিকা ‘রাইজ়িং কাশ্মীর’-এ শুজাত বুখারি লিখেছিলেন, “কাশ্মীরের যে কোনও সাংবাদিকের কাছে সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল বেঁচে থাকা!” এই গ্রহের সর্বত্র সমস্ত আপসহীন সাংবাদিকের কাছে বেঁচে থাকাটাই সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এর আগেও তিন বার হামলা হয়েছে তাঁর উপর। চতুর্থ বার আর শেষ রক্ষা হল না।
‘অসির চেয়ে মসি শক্তিশালী’— অতিব্যবহৃত কথাটিকে মিথ্যে প্রমাণ করে আজ, কাল বা পরশু পৃথিবীর কোনও প্রান্তে হয়তো কলম কেড়ে নিয়ে নতজানু হতে বাধ্য করা সাংবাদিকের মাথা অসির এক কোপে কেটে সেই ভিডিয়ো ভাইরাল করে দেবে ‘শক্তিশালী’ কোনও সংগঠন। কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হোক বা না হোক, হয়তো, হয়তো কেন, নিশ্চিত নামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রাগুক্ত ক্লিশেটিতে ভর করে আবার কাশ্মীরে জেগে উঠবে ‘রাইজ়িং কাশ্মীর’-এর নির্ভীক কলম।
যে ভাবে উঠে দাঁড়িয়েছেন অংশুল ছত্রপতি। অংশুলকে চেনেন না? অংশুলের বাবা রামচন্দ্র ছত্রপতিকে? না চেনারই কথা। আমাদের শোক ও স্মৃতির বয়স যে হেতু সীমিত ওভারের, তাই মনে করিয়ে দেওয়া যাক, রামচন্দ্র ছত্রপতি সিরসা থেকে প্রকাশিত তাঁর সান্ধ্য দৈনিকে ডেরাধিপতি বাবা রাম রহিমের কুকীর্তি প্রথম ফাঁস করেছিলেন। ‘এক্সক্লুসিভ’ আর কী! রাম রহিমের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনা সন্ন্যাসিনীদের চিঠি ছেপেছিলেন। প্রবলপ্রতাপান্বিত ‘বাবা’র সঙ্গে আপস না করার জন্য ২০০২ সালের ২১ নভেম্বর রামচন্দ্রকে গুলি করে খুন করা হয়। অভিযুক্ত বাবা রাম রহিম এবং তাঁর দুই স্যাঙাত নির্মল সিংহ ও কুলদীপ সিংহ।
অসি বনাম মসির লড়াই কি অসম? কার জয় হয় শেষে? কে হাসে শেষ হাসি? প্রশ্নগুলো জলের মতো সহজ। উত্তরও আমাদের অজানা নয়। উত্তর খুঁজে দেখার ফাঁকে আমরা জানতে পারি আর্থিক অনটন, হুমকি আর মামলা চালানোর খরচ সামলে প্রয়াত পিতার পত্রিকা পুনঃপ্রকাশে উদ্যোগী হয়েছেন অংশুল ছত্রপতি। ও হ্যাঁ, রামচন্দ্র ছত্রপতির পত্রিকার নাম ‘পুরা সচ’।
বর্ধমান উদয়চাঁদ মহিলা কলেজে সাংবাদিকতার শিক্ষক