কোফি আন্নান
কোফি আন্নান যখন, ১৯৯৬ সালে, রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রধান হিসাবে নির্বাচিত হন, সেই সময়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাটির পরিস্থিতি খুব ভাল ছিল না। অনেকেই মনে করিতেছিলেন, যে লক্ষ্য লইয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাষ্ট্রপুঞ্জ নির্মিত হইয়াছিল, সে তাহা হইতে ভ্রষ্ট হইয়াছে, তাহার অস্তিত্বেরই আর কোনও অর্থ নাই। এই রকম একটি হতাশা-পূর্ণ পরিবেশের মধ্যে রাষ্ট্রপুঞ্জের দায়িত্ব হাতে লইয়াছিলেন ঘানার কূটনীতিক কোফি আন্নান। বহু ব্যক্তিগত ব্যর্থতা ও সমষ্টিগত অপারগতা সত্ত্বেও, বিশ্বময় সম্মেলক সক্রিয়তার লক্ষ্যটি যে অনর্থক নয়, সেই বিশ্বাস তিনি আবারও ফিরাইয়া আনিলেন। এই ‘অসম্ভব’কে সম্ভব করিবার জন্য দরকার ছিল যথার্থ নেতৃত্বগুণ। আন্নানের মধ্যে তাহা ছিল। রাষ্ট্রপুঞ্জের বর্তমান সেক্রেটারি-জেনারেল আন্তোনিয়ো গুতেরেস আন্নানকে ‘আ গাইডিং ফোর্স ফর গুড’ বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। মঙ্গলের অভিমুখ যে কোন দিকে, তাহা নেতৃত্বের সাফল্যের উপর নির্ভর করে না, নেতৃত্বের চরিত্রের উপর নির্ভর করে। ইরাক যুদ্ধের প্রাক্কালে আন্নান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডবলিউ বুশ ও তাঁহার উপদেষ্টাদের যুদ্ধের অসারতা বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। পারেন নাই। তাঁহার প্রতি কঠিন বিদ্রুপ ও ভর্ৎসনাও সে দিন বর্ষিত হইয়াছিল। তাহাতে আন্নানের সতর্কবাণীগুলির ঐতিহাসিক তাৎপর্য কমে নাই। একটি অস্থির সময়ে দাঁড়াইয়া শান্ত বিবেচনায় ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যিনি অভ্রান্ত সতর্কবাণী দিতে পারেন, তিনিই তো যোগ্য নেতা।
কোফি আন্নান বিষয়ে একটি সমালোচনা হইল, তিনি একটু বেশি মাত্রায় শান্ত। কোনও কিছুই তাঁহাকে বিচলিত করিতে পারে না, এমনকি রোয়ান্ডায় জাতিনিধনের সময়েও নাকি তিনি ‘শান্ত’ ছিলেন। অত্যধিক পদ্ধতিবাদী তিনি, নিয়ম ও পদ্ধতি অতিক্রম করিয়া ন্যায্য কাজও তিনি করিয়া উঠিতে পারেন না। এই অভিযোগ যদি সত্যও হয়, একটি কথা তাঁহার সপক্ষে বলিবার আছে। তিনি নিয়মনিষ্ঠ থাকিতেন ন্যায্যতারই দায়ে। এক বার নিয়ম ভাঙিলে অন্যায্যতা যে কোন ছিদ্রপথে প্রবেশ করিবে, তাহা জানা নাই, বলিতেন তিনি। সকলকে লইয়া নিয়ম-সহকারে চলিবার কাজটি দুরূহ, অনেক সময় সঙ্কটময়ও বটে। কূটনীতির মধ্যবর্তী ধাপগুলি নীতিবিরুদ্ধ ভাবে পার হইলে রোয়ান্ডার জাতিদাঙ্গা থামানো যাইত কি না জানা নাই, কিন্তু আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ভাঙিবার দৃষ্টান্তটি প্রতিষ্ঠিত হইত নিশ্চিত ভাবে।
আশি বৎসরে জীবনাবসানে কোফি আন্নান যে পৃথিবী হইতে বিদায় লইলেন, সেই পৃথিবীতে এই গণতান্ত্রিক রীতি, সম্মেলক কাজ করিবার দৃষ্টান্ত, শান্ত ভাবে অপর পক্ষের যুক্তি শুনিবার স্থৈর্য ইত্যাদি ক্রমশই বিরল প্রজাতির বস্তুতে পরিণত হইতেছে। ১৯৯৭ সাল হইতে ২০০৬ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব থাকাকালীন ২০০১ সালে নোবেল পুরস্কারটি তিনি ও তাঁর প্রতিষ্ঠান এক সঙ্গে পাইয়াছিলেন। যাঁহারা রাষ্ট্রপুঞ্জের অর্থহীনতার সওয়াল করেন, তাঁহাদের সে দিন মনে করানো গিয়াছিল, বিশ্বশান্তির আহ্বান যৎসামান্য হইলেও তাহা অত্যন্ত মূল্যবান। সতেরো বৎসর পর, তাঁহার প্রয়াণকালে, উত্তরোত্তর অস্থির ও সঙ্কটময় বিশ্ব-রাজনীতির প্রেক্ষিতে ওই আহ্বানটির গুরুত্ব আবারও স্মরণ করিবার সময় আসিয়াছে।