দূষণশ্রী

বস্তুত, দূষণের ক্ষেত্রে কলিকাতা ও দিল্লির লড়াইটি খরগোশ ও কচ্ছপের গল্প স্মরণ করাইয়া দেয়। দূষণে দিল্লিই শ্রেষ্ঠ— বহুলপ্রচারিত। কিন্তু কলিকাতা প্রচারের মধ্যে না থাকিয়াও চুপচাপ দিল্লিকে টপকাইয়া যাইবার ভয় দেখাইতেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:১০
Share:

—প্রতীকী ছবি।

শ্রী-মুখর পশ্চিমবঙ্গ সম্প্রতি আরও একটি খেতাব প্রাপ্ত হইয়াছে। না, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে এই খেতাব দিতে হয় নাই, তাঁহার রাজধানী নিজগুণে ইহা অর্জন করিয়াছে। খেতাবটি সহজলভ্য ছিল না। দখল করিবার জন্য দেশের রাজধানীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামিতে হইয়াছে কল্লোলিনী তিলোত্তমাকে। মাঘের শেষে ফল ঘোষিত। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ সূত্রে খবর, বায়ুসূচকের মাপকাঠি অনুযায়ী ফেব্রুয়ারির প্রথম পনেরো দিনের মধ্যে আটটি দিনই দূষণের নিরিখে কলিকাতা পিছনে ফেলিয়াছে দিল্লিকে। শুধু তাহাই নহে, ধারাবাহিকতাটিও তারিফ করিবার মতো। ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে কলিকাতার ঝুলিতে একটিও দূষণমুক্ত ‘ভাল’ দিন নাই। পনেরো দিনের বাকি দিনগুলিতেও সে ‘খারাপ’ মানটি যত্ন সহকারে ধরিয়া রাখিয়াছে। ১ ফেব্রুয়ারি তাহার স্থান ছিল দেশের সর্বাপেক্ষা দূষিত শহরগুলির মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে। ধারাবাহিক উন্নতিটি চোখে পড়িবার মতো। যথার্থই ‘দূষণশ্রী’ হইয়াছে কলিকাতা।

Advertisement

বস্তুত, দূষণের ক্ষেত্রে কলিকাতা ও দিল্লির লড়াইটি খরগোশ ও কচ্ছপের গল্প স্মরণ করাইয়া দেয়। দূষণে দিল্লিই শ্রেষ্ঠ— বহুলপ্রচারিত। কিন্তু কলিকাতা প্রচারের মধ্যে না থাকিয়াও চুপচাপ দিল্লিকে টপকাইয়া যাইবার ভয় দেখাইতেছে। নীরব সাফল্যের কৃতিত্বখানি অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলির প্রাপ্য। তাহারা দূষণকে ধর্তব্যের মধ্যেই ধরে না। পরিবেশ সংক্রান্ত আইন, আদালত, মন্ত্রকসজ্জিত সরকার বরং আমোদ-উৎসবের অজুহাতে দূষণে রীতিমতো প্রশ্রয় দিয়া থাকে। অন্য দিকে বিরোধীরাও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় লইয়া গুরুতর ব্যস্ত। সুতরাং, গোকুলে দূষণ বাড়িতেছে। দূষণরোধে দিল্লির সরকারের একটি মরিয়া প্রচেষ্টা ছিল। ‘বায়ুদূষণ’ ঠেকাইবার কাজটি যে সরকার তথা পুরসভার, এবং তাহার গুরুত্ব নানাবিধ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের তুলনায় কম নহে, বরং সময়বিশেষে বেশি— সেই বোধটুকু ছিল। পশ্চিমবঙ্গবাসীর দুর্ভাগ্য, সেই বোধ বিসর্জন দিয়াই এই রাজ্যের রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচনে নামে। অন্যথা হইবার কথাও নহে। দূষণ সৃষ্টিতে যাঁহাদের অবদান প্রশ্নাতীত, সেই প্রোমোটার, অটো ইউনিয়ন, বাজি কারখানার মালিকদের লভ্যাংশের একটা অংশ ক্ষমতার ভাণ্ডারে নিয়মিত জমা পড়ে, এমন অভিযোগ বহুশ্রুত। দূষণ লইয়া শব্দ খরচ করিবে কে?

দুর্ভাগ্যের কথা, নাগরিক সমাজের ভাবনাও কার্যত একই পথের পথিক। বস্তুত অনেক ক্ষেত্রে উভয়েই উভয়ের পরিপূরক। আইন, পরিবেশ দফতর— সব থাকা সত্ত্বেও সরকার সেগুলির ব্যবহারে চরম অনিচ্ছুক, নাগরিকও আইনের ফাঁক খুঁজিতে উন্মুখ। অথচ রাজনৈতিক দল নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের বাহিরে না যাইতে চাহিলে গণতান্ত্রিক সমাজে চাপ সৃষ্টির ভারটি নাগরিকেরই। কিন্তু দূষণ কমাইতে ব্যর্থ বলিয়া সরকার পড়িয়া যাইবে, অথবা দূষণ সংক্রান্ত সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি নাই বলিয়া দল নির্বাচনে ধরাশায়ী হইবে— এই পোড়া দেশে ইহা কষ্টকল্পনামাত্র। বস্তুত, নাগরিক সমাজ দূষণকে প্রাত্যহিকের মধ্যে মানিয়া লইয়াছে। ভোরের দূষণজনিত কারণে প্রাতর্ভ্রমণ বন্ধ, শ্বাসকষ্টজনিত অসুখ, ক্যানসারের প্রকোপ বৃদ্ধি— কিছুই নাগরিক সমাজের এই মানিয়া লওয়ার প্রবণতাকে ধাক্কা দিতে পারে নাই। ইহাই সর্বাপেক্ষা চিন্তার। দূষণ দৈনন্দিনতার অঙ্গ হইয়া উঠিলে তাহাকে জব্দ করিবে কে?

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন