দেশের মধ্যে তুলনায় অসাম্প্রদায়িক বলিয়া কলিকাতার, এবং পশ্চিমবঙ্গের, একটি খ্যাতি আছে। খ্যাতিটি হয়তো অনেকাংশেই বাহ্যিক, এবং আতিশয্যমণ্ডিত। ইহা অস্বীকার করা কঠিন যে, এই রাজ্যের অনেক স্থানে একটি নিহিত ও প্রচ্ছন্ন বিদ্বেষভাব নিয়মিত নিজেকে জানান দেয়, পরোক্ষ ও আপাত-সামান্য ঘটনার মধ্য দিয়া। মনে রাখা দরকার, সামাজিক-সাম্প্রদায়িক স্থিতি ও শান্তির বিষয়টি শুধুমাত্র সঙ্কটের সময়েই পরীক্ষিত হয় না, সাধারণ দৈনন্দিন জীবনেও তাহার ছাপ পড়ে। সেই দিক দিয়া দেখিলে, কলিকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের ‘শান্তি’ বিষয়ে অধিক কথা বলিলে তাহাতে অতিরঞ্জন থাকিতে পারে। কিন্তু পাশাপাশি এই কথাও সত্য যে, বেশ কিছু জাতীয় সঙ্কটের সময়ে বাংলায় পরিস্থিতি তুলনায় শান্ত থাকিয়াছে। কেন? কী ভাবে? বড় রকমের বিপন্নতার সময়ে এই রাজ্যের গত কয়েক দশকের ইতিহাস যে ভারতের অন্য অনেক রাজ্যের তুলনায় ভাল, তাহার কারণ কী? উত্তরটি সম্ভবত রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মধ্যে লুকাইয়া। পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন যখনই শক্ত হাতে পরিস্থিতির হাল ধরিয়াছে, তখনই সঙ্কট এড়ানো সম্ভব হইয়াছে। একটি উজ্জ্বল উদাহরণ, ১৯৯২ সাল। এই মুহূর্তে পুলওয়ামার ভয়ঙ্কর সন্ত্রাস লইয়া সারা দেশে কাশ্মীরি-বিরোধিতা ও তাহার সূত্রে মুসলিম-বিরোধিতার যে অসহনীয় বাড়াবাড়ি চলিতেছে, তাহা হইতে যদি পশ্চিমবঙ্গকে রক্ষা করিতে হয়, তবে রাজ্যের বর্তমান প্রশাসনকে এই ইতিহাস মনে রাখিতে হইবে। আশার কথা, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিমধ্যেই এই মর্মে পুলিশকে বার্তা দিয়াছেন। জানাইয়াছেন যে, সম্প্রীতি রক্ষার জন্য যথাসম্ভব কড়া হাতে অবস্থা সামলানো হউক। ইহা যে কেবল প্রশাসনের একার কাজ নয়, অন্য রাজনৈতিক দলগুলিকেও একই সঙ্গে এই দায়িত্ব লইতে হইবে, সমাজকেও তাহার দায় পালন করিতে হইবে, এই জরুরি কথাটিও তিনি স্মরণ করাইয়াছেন।
সাবধানবাণীটি সময়োচিত। কেননা ইহার মধ্যেই নানা অশান্তির সংবাদ ভাসিয়া আসিয়াছে, উগ্র ‘দেশপ্রেমিক’দের দেশপ্রেমের নমুনা হিসাবে হামলা ও হুমকির খবর মিলিতেছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় খুন-ধর্ষণের মাধ্যমে ‘দেশপ্রেম’ ছড়াইবার শপথ ধ্বনিত হইতেছে। এই প্রচারক ও প্রতারক দেশপ্রেমিকদের সামলাইবার জন্য প্রশাসন দ্রুত ও কড়া পদক্ষেপ করুক। অশান্তি হিংসা দাঙ্গা বাধাইবার সর্বাপেক্ষা কার্যকর বাহনটি হইল গুজব। সুতরাং সোশ্যাল মিডিয়ার স্তরে এবং বৃহত্তর সামাজিক পরিসরে কী ভাবে গুজবের মোকাবিলা করা যায়, তাহার আগাম প্রস্তুতি জরুরি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অশান্তির ধরনটি বলিয়া দেয়, ক্রমশই প্রবল আকার ধারণ করিতেছে হিন্দুত্ববাদীদের বিদ্বেষপ্রচার-কৌশল। কাশ্মীরে সন্ত্রাস-নিধনের প্রেক্ষিতে কলিকাতার রাস্তায় গৈরিক পতাকা হাতে ‘ভারতমাতা’র নামে গর্জন করিতেছে দলীয় গুন্ডারা। নির্বাচন আসন্ন। সুতরাং একটি কুটিল অভিসন্ধি ক্রমশ দেশ জুড়িয়াই প্রবলতর হইতেছে। ইহাকে প্রতিহত করা দরকার।
প্রতিহত করা দরকার পশ্চিমবঙ্গের সুনাম রক্ষার স্বার্থেও। সেই সুনাম এই দুর্দিনেও সম্পূর্ণ চলিয়া যায় নাই। লক্ষণীয়, আজও কাশ্মীরি মায়েরা অনেকেই তাঁহাদের সন্তান কাশ্মীরের বদলে কলিকাতায় থাকিলেই অধিক নিশ্চিন্ত থাকেন। কলিকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের এই নিরাপত্তাবোধ এক দিনে তৈয়ারি হয় নাই। আজ ইহাকে নষ্ট করিবার চেষ্টা চলিতেছে, কিন্তু সমাজের নিজস্ব চরিত্রে ও মানসিকতায় সেই অপচেষ্টাকে প্রতিহত করিবার শক্তি আজও কিছু কম নাই। বড় সঙ্কটের দিনে আপন শক্তি ও সংহতি রক্ষা করিবার বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের সামর্থ্যের ক্ষয় হইয়াছে বটে, কিন্তু তাহার পুনরুজ্জীবন অসম্ভব নহে। তবে, তাহা সহজও নহে। কঠিন কাজটি সম্পাদনে প্রশাসনের ভূমিকা বিরাট। সেই ভূমিকা তাহারা যদি পালন না করে, তবে মুখ্যমন্ত্রীর কথাই সার হইবে।