প্ল্যাটফর্মে পাঁচ জন

গেছোদাদার নিকট মেট্রো রেলের এই বিপ্লব প্রকৃত প্রস্তাবে তাঁহার চরিত্রের বাস্তবায়ন। অতঃপর, ট্রেন কোথায় আছে, তাহা জানিবার পূর্বে জানিতে হইবে যে ট্রেন কোথায় কোথায় নাই। এবং, কোথায় থাকিতে পারে। হাইজ়েনবার্গও এইখানেই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁহার অনিশ্চয়তা তত্ত্বকে সামান্য পাল্টাইয়া লইলেই স্পষ্ট, ট্রেনের অবস্থান যত নিখুঁত ভাবে জানা যাইবে, তাহার গতিবেগ ততই অজ্ঞাত হইবে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share:

ফাইল চিত্র।

একই প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াইয়া আছেন ওয়ার্নার হাইজ়েনবার্গ, শ্রীকৃষ্ণ ও গেছোদাদা। খানিক দূরত্বে আরও দুই জন— এক জনের নেহরু জ্যাকেটের বুকপকেট হইতে উঁকি মারিতেছে ‘অচ্ছে দিন’ লেখা চিরকুট, অন্য জনের পায়ে হাওয়াই চপ্পল। সরলরৈখিক সময়কে মানিলে স্বীকার করিতেই হইবে, এমন ঘটনা এখনও ঘটে নাই। ঘটিবার কারণও নাই। কিন্তু কলিকাতা মেট্রো যে হেতু স্ট্যাটিক বা জড় সময়(সারণি)-কে বিদায় জানাইবার কথা ভাবিতেছে, অতএব সময়ের রৈখিক চরিত্রকে আর মান্য করিবার দায় অন্তর্হিত— অন্তত মেট্রো রেলের প্রসঙ্গে। জঙ্গম সময়সারণির আবির্ভাবের মহালগ্ন পার করিয়া কোনও এক স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বিপুল ভিড়ের মধ্যে, কিন্তু পাঁচ জন দাঁড়াইয়া আছেন। প্রশ্ন উঠিবে, কেন? উত্তরটি স্পষ্ট। মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষ জানাইয়াছেন, যে হেতু ট্রেন আর নির্দিষ্ট সময়সারণি মানিয়া চলে না, সেই সমস্যার একটি সমাধান তাঁহারা ভাবিয়া পাইয়াছেন— অতঃপর আর সময়সারণিই থাকিবে না। এই বৈপ্লবিক সমাধানটিই স্থান ও কালের ব্যবধান ঘুচাইয়া পাঁচ পাত্রকে এক প্ল্যাটফর্মে টানিয়া আনিয়াছে।

Advertisement

গেছোদাদার নিকট মেট্রো রেলের এই বিপ্লব প্রকৃত প্রস্তাবে তাঁহার চরিত্রের বাস্তবায়ন। অতঃপর, ট্রেন কোথায় আছে, তাহা জানিবার পূর্বে জানিতে হইবে যে ট্রেন কোথায় কোথায় নাই। এবং, কোথায় থাকিতে পারে। হাইজ়েনবার্গও এইখানেই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁহার অনিশ্চয়তা তত্ত্বকে সামান্য পাল্টাইয়া লইলেই স্পষ্ট, ট্রেনের অবস্থান যত নিখুঁত ভাবে জানা যাইবে, তাহার গতিবেগ ততই অজ্ঞাত হইবে। অর্থাৎ, কোন স্টেশন হইতে কত সময়ে ট্রেন কোন স্টেশনে পৌঁছাইবে, তাহা নিশ্চিত জানিবার সাধ্য কোয়ান্টাম ফিজ়িক্সের নাই। স্বাভাবিক ভাবেই, মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষও তাহা জানে না। সেই না জানা যে দূষণীয় নহে, বরং নিতান্ত স্বাভাবিক, মেট্রোর বিপ্লবে সেই নির্ঘোষ রহিয়াছে। ট্রেন চালানো মেট্রো কর্তৃপক্ষের কাজ। তাহার ফল কী হইবে, সেই আশা করায় শ্রীকৃষ্ণের বারণ আছে, কথাটি কর্তারা স্মরণ করাইয়া দিতে পারেন। বিশেষত সেই বিন্দুতে, যেখানে বিজ্ঞান ও ধর্মের মিলন ঘটিয়াছে। অধুনা ভারতে অবশ্য রাজনীতির মহাসঙ্গমে বিজ্ঞানকে নিয়মিত ধর্মের ঘাটে জল খাইতে হইতেছে, কিন্তু আপাতত সেই প্রসঙ্গ অবান্তর। রাজনীতির যে দুই চরিত্র এই পরাবাস্তব প্ল্যাটফর্মে হাজির, তাঁহারা জানিবেন, ফলাফলের অস্তিত্ব গায়েব করিয়া দেওয়াই রাজনীতির খেলার আসল প্রতিভা। যেমন, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করিতে পারিলে তৎসংক্রান্ত রিপোর্টটিকে চাপিয়া যাওয়া; জিডিপির বৃদ্ধির হারের হিসাব যত ক্ষণ না মনঃপূত হইতেছে, তত ক্ষণ এক রিপোর্ট ফেলিয়া অন্য রিপোর্ট তৈরি করা; নোট বাতিলের প্রকৃত লক্ষ্য কী ছিল, ফলাফলের ভিত্তিতে তাহাকে পাল্টাইয়া লওয়া ইত্যাদি। অথবা, রাজনৈতিক বিরোধের উল্লেখ করিয়া যে কোনও পরিসংখ্যান দিতে অরাজি হওয়া। তাঁহারা জানিবেন, রাজনীতির প্রজ্ঞা হইল, সমাধানসূত্র খুঁজিবার অপেক্ষা ঢের জরুরি কাজ সমস্যাটিকে ধামাচাপা দেওয়া। স্নানের নোংরা জল থাকিয়া যাউক ক্ষতি নাই, শিশুটিকে ফেলিয়া দেওয়া অধিকতর জরুরি। অনুমান করা চলে, মেট্রো রেলের সিদ্ধান্তে তাঁহারা সেই প্রজ্ঞার সন্ধান পাইয়াছেন।

যে সিদ্ধান্ত বিজ্ঞানের সহিত ধর্মকে মিলাইয়া দিতে পারে, রাজনীতিকে দাঁড় করাইয়া দিতে পারে পরাবাস্তব জমিতে, তাহা সামান্য নহে। আশা করা চলে, বিপ্লব এইখানেই ফুরাইবে না। মেট্রো রেলের পাতাল হইতে তাহা ভূতলে উঠিয়া আসিবে। কয়েকটি হাতেগরম উদাহরণ দিয়া দেখানো সম্ভব, এই বিপ্লবের জন্য কতখানি জমি প্রস্তুত হইয়া আছে। মাধ্যমিকে পর পর প্রশ্ন ফাঁস হইতেছে। চটজলদি সমাধান, প্রশ্নপত্র বস্তুটিকেই তুলিয়া দেওয়া। ছাত্ররা যে বিষয়ে যাহা জানে, তাহা লিখিয়া আসিলেই যথেষ্ট হইবে। গর্ভবতী মহিলাদের মধ্যে রক্তাল্পতার হার যদি কমানো না যায়, তবে বেসরকারি বিমা সংস্থাকে প্রতি বৎসর কত টাকা প্রিমিয়াম বাবদ দেওয়া হইতেছে, তাহাকেই স্বাস্থ্যখাতের মূল সূচক হিসাবে গণ্য করা যাইবে। ট্রেন দুর্ঘটনার রাশ টানা না গেলে বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের তীব্র গতির নকল ভিডিয়ো টুইট করিয়া দিলেই উন্নতির প্রমাণ মিলিবে। মোট কথা, ফলাফল বস্তুটির কোনও গুরুত্ব অবশিষ্ট রাখিলে চলিবে না। গোটা ভারতকে সেই স্বর্গে জাগরিত করিতে হইবে যেখানে গোটা দেশই প্রাথমিক স্কুল— কোথাও পাশ-ফেল নাই।

Advertisement

যৎকিঞ্চিৎ

মোবাইল এসে গিয়ে টোকাটুকিতেও বিপ্লব ঘটে গিয়েছে। লোকে পরীক্ষার হল থেকে হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্ন পাঠিয়ে দিচ্ছে, হয়তো হোয়াটসঅ্যাপেই তার উত্তর আসছে, অবশ্য পাইপ বেয়ে কার্নিশে ঝুলেও লোকে উত্তর জোগান দিচ্ছে, সব মিলিয়ে রোমহর্ষক ও পেশাদার পাপ, জেমস বন্ডের অভিযান। প্রতিষ্ঠানবিরোধী দ্রোহও বলা যায়। মুখস্থবিদ্যা-ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে জেহাদ। ঘেরাও-টেরাও তো হয়েছেই, ‘টোকাটুকি আমাদের জন্মগত অধিকার’ মিছিলটা বাকি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন