প্রতিবন্ধী অধিকারের মুখ্য কমিশনার কমলেশ পান্ডে ডিসলেক্সিকদের প্রসঙ্গে মোদীর বক্তব্যে আপত্তিকর কিছু দেখছেন না। ছবি: পিটিআই।
স্মার্ট ইন্ডিয়া হ্যাকাথন নামক একটি অনুষ্ঠানে, বি টেক পড়ুয়া এক ছাত্রী যখন তাঁহার প্রকল্পটি ব্যাখ্যা করিতে গিয়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সম্মুখে বলিলেন, তাঁহার এই কাজটি ডিসলেক্সিয়া-গ্রস্তদের উন্নতিকল্পে প্রস্তুত হইয়াছে, ডিসলেক্সিকরা শিখিবার বা লিখিবার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ধীর হইলেও তাঁহাদের বুদ্ধি বা সৃষ্টিশীলতার স্তর অত্যন্ত উচ্চ, যেমন ‘তারে জমিন পর’ ছবির এক চরিত্র— মোদী তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, এই কাজটি কি ৪০ হইতে ৫০ বৎসর বয়স্ক শিশুদেরও সাহায্য করিবে? ইঙ্গিত ধরিতে পারিয়া উপস্থিত যুবক-যুবতীদের মধ্যে হাস্যরোল পড়িয়া যাইল। করতালিও ধ্বনিত হইল। ইহার মধ্যে কিঞ্চিৎ হতচকিত ছাত্রীটি যখন বলিলেন যে সেই বয়সের মানুষেরও ইহা কাজে লাগিবে, মোদী বলিয়া উঠিলেন, তাহা হইলে তাহাদের মাতাগণ অত্যন্ত খুশি হইবেন। ইহার পর অধিক হাস্য ও অধিক করতালি। ইতিমধ্যেই এই কুরসিকতা লইয়া দেশ জুড়িয়া প্রতিবাদ ধ্বনিত হইয়াছে, অনেকেই বলিয়াছেন ইহা বিশেষত ডিসলেক্সিকদের প্রতি ও সাধারণ ভাবে প্রতিবন্ধীদের প্রতি অপমানজনক। ‘দ্য ন্যাশনাল প্ল্যাটফর্ম ফর দ্য রাইটস অব দ্য ডিসএব্লড’ সংগঠন দাবি করিয়াছে, উক্তিটির জন্য মোদীকে ক্ষমা চাহিতে হইবে। কেহ ইহাও উল্লেখ করিয়াছেন যে আলেকজ়ান্ডার গ্রাহাম বেল, লিউইস ক্যারল, গালিলেয়ো আদি বহু মনীষী ডিসলেক্সিক ছিলেন।
কিন্তু এই ঘটনায় আরও যাহা লক্ষণীয়: সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক ভাবে, একটি স্বতন্ত্র মঞ্চে, প্রায় বলপূর্বক, রাহুল গাঁধীর কথা টানিয়া আনিয়া কুরুচিপূর্ণ ব্যঙ্গোক্তি ছুড়িয়া দিবার প্রবণতা। কেহ কেহ বলিয়াছেন, মোদী হয়তো রাহুলের নির্বাচনী চ্যালেঞ্জ লইয়া এতটাই চিন্তিত যে অবচেতনেও তাঁহার নামই জপ করিতেছেন, রাবণ যেমন রামকে শত্রুভাবে ভজনা করিয়াছিলেন। সেই অনুমান সত্য হউক বা না হউক, ছাত্রছাত্রীদের সভায় নিক্ষিপ্ত বাক্যগুলির সহিত মোদী এমন এক হাস্য করিতেছিলেন, যাহার মধ্যে তাঁহার সংবেদনহীনতা বিশেষ পরিলক্ষিত হয়। যে কোনও আচরণের স্থানকাল সম্পর্কিত জ্ঞান প্রয়োজন— নৃত্যানুষ্ঠানে যাহা স্বাভাবিক, সংসদে তাহা অসমঞ্জস। প্রধানমন্ত্রীর কেদারা হইতে যদি এই রূপ কাণ্ডজ্ঞানশূন্য, অভদ্র, অসংযত আচরণ করা হয়, তাহা একই সঙ্গে অনুষ্ঠান এবং ক্ষমতাবস্থানের গুরুত্বকে অপমান করে।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি অসৌজন্য ইদানীং ভারতীয় রাজনীতির প্রকট লক্ষণ। কেবল প্রধানমন্ত্রী নহেন, অনেকেরই মুখ হইতে অশিষ্ট বাক্যের স্রোত সতত বহমান। রাহুল গাঁধী কিছু দিন পূর্বেই মোদীকে অপমান করিতে গিয়া তাঁহাকে ‘স্কিৎজ়োফ্রেনিক’ বলিয়াছেন। তাঁহার ব্যাখ্যা, মোদী নিজেকে চৌকিদার ও চোর, দ্বিবিধ সত্তায় ভাঙিয়া ফেলিয়াছেন। বিজেপি বিধায়ক সাধনা সিংহ বলিয়াছেন, মায়াবতী নপুংসকেরও অধম। এই সংস্কৃতি এমন স্তরে পৌঁছাইয়াছে যে নাগরিকেরা ইহার মধ্যে অসভ্যতা না খুঁজিয়া প্রবল আমোদ খুঁজিতেছেন। মোদীর ডিসলেক্সিয়া সম্বন্ধীয় উক্তিটির অর্থ বুঝিয়া তাই সমবেত যুবক-যুবতীরা অস্বস্তিতে পড়েন নাই, প্রবল হর্ষে এই বিদ্রুপকে স্বাগত জানাইয়াছেন। যুবসমাজ জাতির ভবিষ্যৎ। উচ্চশিক্ষিত যুবসমাজের এই অভব্যতার নির্লজ্জ উদ্যাপন দেখিয়া ভয় করে, ভবিষ্যৎ ভারতে কুরুচির স্রোত প্লাবনে না পরিণত হয়!