সম্পাদকীয় ১

উদ্বেগজনক

দৃশ্যটি জনমানসে এখনও সজীব। চর্চাও চলিতেছে বিস্তর। তাঁহার যাত্রাপথে সমবেত কণ্ঠে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি শুনিয়া রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্রোধ কী মাত্রায় পৌঁছিয়াছিল এবং তাহা প্রকাশের জন্য তিনি কী ধরনের ভাষা ও ভঙ্গি প্রয়োগ করিয়াছিলেন, টিভির পর্দায় তাহা দেখিবার পরে জনসাধারণের মধ্যে এই চর্চা স্বাভাবিক।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০১৯ ০০:০১
Share:

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

দৃশ্যটি জনমানসে এখনও সজীব। চর্চাও চলিতেছে বিস্তর। তাঁহার যাত্রাপথে সমবেত কণ্ঠে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি শুনিয়া রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্রোধ কী মাত্রায় পৌঁছিয়াছিল এবং তাহা প্রকাশের জন্য তিনি কী ধরনের ভাষা ও ভঙ্গি প্রয়োগ করিয়াছিলেন, টিভির পর্দায় তাহা দেখিবার পরে জনসাধারণের মধ্যে এই চর্চা স্বাভাবিক। কারণ মুখ্যমন্ত্রী গাড়ি থামাইয়া ধ্বনি উদ্‌গিরণকারী যুবকদের দিকে কুকথা মুখে লইয়া ধাবমান— এমন ঘটনা বিরল বইকি! তদপেক্ষা বিরল হইল, মুখ্যমন্ত্রী ধমক দিয়া ফিরিয়া আসা মাত্র সেই যুবকেরাই পুনরায় গাড়ির পিছন হইতে তাঁহাকে কার্যত উত্ত্যক্ত করিবার ভঙ্গিতে ‘জয় শ্রীরাম’ বলিতে অকুতোভয়। এক বার নহে, তিন বার। আর প্রতি ক্ষেত্রেই মুখ্যমন্ত্রীকে পথে নামিয়া আস্ফালন করিতে দেখা গেল। সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে সমগ্র দেশের মতো এই রাজ্যেও বিজেপির লক্ষণীয় অগ্রগতির প্রেক্ষিতে বিষয়টি সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়। বস্তুত পুরা প্রচারপর্বে নরেন্দ্র মোদীর সহিত মমতার দ্বৈরথ এ বার তুঙ্গে উঠিয়াছিল। কটুবাক্য, কটাক্ষ ছাপাইয়া মুখ্যমন্ত্রীর কথার লব্জে প্রধানমন্ত্রী ‘তুই’ বলিয়াও সম্বোধিত হইয়াছিলেন। সেই পর্বেও এক বার পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনায় সফরকালে ‘জয় শ্রীরাম’ শুনিয়া ক্ষিপ্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাড়া করিয়া গিয়াছিলেন। সুতরাং, এখন যাহা ঘটিতেছে, তাহা যে রাজ্যের শাসক তৃণমূলের আসন-হ্রাস এবং বিজেপির সংখ্যাবৃদ্ধির প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নাই।
কিন্তু প্রতিক্রিয়া প্রকাশের যে ছবি প্রতিভাত হইতেছে, তাহা কিসের পরিচায়ক? ক্ষোভ, হতাশা, মান-অভিমান, ক্রোধ ইত্যাদি সবই মনুষ্যচরিত্রের সাধারণ ধর্ম। আবার কোথায়, কী ভাবে তাহার কত দূর প্রকাশ সমীচীন, সেটিও সঠিক চেতনাসম্পন্ন মানুষের স্বাভাবিক বোধের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া আবশ্যক। মুখ্যমন্ত্রীর ন্যায় এক জন দায়িত্বশীল পদাধিকারীর কাছে সেই বিচারবোধ আরও বেশি প্রত্যাশিত। কারণ যাঁহারা মান্য নেতা, তাঁহারা যে দলেরই হউন, এক অর্থে পথপ্রদর্শকও বটে। তাঁহাদের দৃষ্টান্ত সমাজে সতত ছায়া ফেলে। সেই ছায়া মলিন দেখাইলে তাহাতে অবাঞ্ছনীয় পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়া অসম্ভব নয়। বলিতে দ্বিধা নাই, রাজ্যের অগ্রগণ্য নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতাদেবীর সাম্প্রতিক কার্যপদ্ধতি ও কথাবার্তা বিচারবোধের সেই লক্ষণরেখা অতিক্রম করিতেছে। গণতান্ত্রিক দেশে ‘জয় শ্রীরাম’ বলা কোনও গর্হিত অপরাধ বলিয়া গণ্য হইতে পারে না। আবার কেউ তাহা বলিতে না চাহিলে তাঁহাকে বলপূর্বক সে কথা বলাইবার চেষ্টাও একই রকম নিন্দনীয়। এ সবেরই পিছনে রাজনীতির সূক্ষ্ম চাল আছে। কিন্তু স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী তাঁহার পথে নিছক ধ্বনি কিংবা স্লোগান শুনিয়াই সংযম হারাইতে পারেন না। তাঁহার রাজ্যে বসবাসকারী হিন্দিভাষীদের উদ্দেশে কার্যত হুঁশিয়ারি দিয়া স্মরণ করাইয়া দিতে পারেন না যে, এখানে তিনিই তাঁহাদের ‘খাওয়া-পরার’ অভিভাবক। দুর্বাক্য কিংবা দুরাচারের জল এই ভাবে কত দূর গড়াইতে পারে, ভাবিয়া শঙ্কা হয়। এত দিন যে তৃণমূল নেত্রীকে দেখা গিয়াছে, তিনি আর যাহাই করুন, ধর্মীয় ভেদাভেদ বা প্রাদেশিকতা দোষে দুষ্ট ছিলেন না। সহসা তাঁহার এই আচরণ তাই বিস্ময় এবং উদ্বেগের উদ্রেক করে।
নির্বাচনী ফলের অভিঘাত এবং অনাগত ভবিষ্যতের ভাবনা সম্ভবত তাঁহার মধ্যে এক অস্থিরতা সৃষ্টি করিয়াছে। বুধবার কলিকাতায় ইদের সভায় বক্তব্য পেশ করিতে আসিয়া রাজনৈতিক হুঙ্কার দিবার মধ্যেও সেই অস্থিরতা-প্রসূত দৃষ্টিক্ষীণতা দেখা গেল। আমলা-পুলিশদের রদবদলের তালিকা ঘণ্টায় ঘণ্টায় পরিবর্তন করাও তাঁহার ও তাঁহার প্রশাসনের অস্থিরতার আর এক প্রতিফলন। রাজ্যের প্রধান নেত্রী এবং প্রশাসনের কান্ডারি হিসাবে তিনি দ্রুত এই অস্থিরতা কাটাইয়া উঠিলে রাজ্য ও রাজনীতি উভয়ের পক্ষেই তাহা মঙ্গলজনক হইবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement