সম্পাদকীয় ১

ধুন্ধুমার

আরও একটি বামপন্থী মিছিল শেষ অবধি পুলিশ ও জনতার খণ্ডযুদ্ধে শেষ হইল। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির চলন বলিবে, এই মিছিলই সম্ভবত শেষ নহে— কে শাসক পক্ষে আর কে বিরোধী আসনে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৭ ০০:০৯
Share:

আরও একটি বামপন্থী মিছিল শেষ অবধি পুলিশ ও জনতার খণ্ডযুদ্ধে শেষ হইল। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির চলন বলিবে, এই মিছিলই সম্ভবত শেষ নহে— কে শাসক পক্ষে আর কে বিরোধী আসনে, সেই বিচারের অপেক্ষা না করিয়াই আরও অনেক মিছিল, প্রশাসনিক সদর দফতরের অভিমুখে আরও অনেক অভিযানের একই পরিণতি হইবে। কারণ, ডেলিবারেটিভ ডেমোক্র্যাসি বা আলোচনাভিত্তিক গণতন্ত্রের অনুশীলন এই রাজ্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতি নহে। ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই’-এর স্লোগানটিকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সমাজ বড় বেশি আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করিয়াছে। পথে নামিয়া ধুন্ধুমার বাধাইয়া দেওয়াই সেই ল়ড়াইয়ের পরাকাষ্ঠা। এই রাজনীতির ইতিহাস দীর্ঘ— কংগ্রেসি জমানায় বামপন্থীদের আন্দোলন হইতে বাম আমলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতি পার হইয়া এখন ব্যাটন ফের শতরূপ ঘোষদের হাতে। সব জমানাতেই অবশ্য গণতন্ত্রের অনুশীলনে শাসকদেরও অনীহা সমান। বামপন্থীদের নবান্ন অভিযানের ডাক শুনিয়া তাহাকে সদর্থক আলোচনার পথে প্রবাহিত করিবার কোনও উদ্যোগ শাসকদেরও ছিল না। বস্তুত, সেই আলোচনা যে একটি সম্ভাবনা, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি হয়তো তাহা কল্পনাই করিতে পারে না। মঙ্গলবারের নবান্ন অভিযান শান্তিপূর্ণ হইবার কথা ছিল, বাম সমর্থকদের প্রস্তুতি দেখিলে তেমন দাবি করিবার উপায় নাই। পুলিশকে উস্কাইলে পাল্টা মার খাইতে হইবে, বাম নেতারা বিলক্ষণ জানিতেন— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনের ছয় বৎসর ভিন্নতর প্রত্যাশার কোনও অবকাশ রাখে নাই। মার খাওয়াই হয়তো তাঁহাদের উদ্দেশ্য ছিল, কারণ রাজ্য রাজনীতিতে নিজেদের তাৎপর্য বজায় রাখিবার কোনও ইতিবাচক পথ আলিমুদ্দিন স্ট্রিট এই ছয় বছরে খুঁজিয়া পায় নাই। আলোচনাভিত্তিক গণতন্ত্রের অনুশীলনে দীর্ঘ দিনের অনভ্যাস তাহাদের এমনই অসহায় করিয়াছে।

Advertisement

তবুও, শুধু রাজনৈতিক সংস্কৃতির ঘা়ড়েই মঙ্গলবারের যাবতীয় দায় চাপাইয়া দেওয়া যাইবে না। ব্যর্থতা প্রশাসনের। কখন, কোন পথে মিছিল নবান্নের দিকে আসিবে, কত লোক হইতে পারে, গোলমাল বাধাইবার উদ্দেশ্য বা প্রস্তুতি আছে কি না, পুলিশের নিকট কোনও খবরই ছিল না। এই জনতাকে কী ভাবে সামলাইতে হয়, হিংস্র না হইয়াও কী ভাবে কঠোর হইতে হয়, কলিকাতা পুলিশ দৃশ্যত তাহা জানে না। ফলে, মার খাইয়া পাল্টা মার দেওয়ার মৌলিক প্রবৃত্তিই তাহার চালিকাশক্তি হইয়াছে। সাংবাদিক নিগ্রহের ঘটনাগুলি দেখাইয়া দেয়, কাণ্ডজ্ঞান নামক বস্তুটি পুলিশকর্তারা বাড়িতেই রাখিয়া আসিয়াছেন। এই হিংস্রতার রাজনৈতিক তাৎপর্য কী, বিচার করিবার ক্ষমতা তাঁহাদের ছিল না। যাহা মূলত আইনশৃঙ্খলার প্রশ্ন ছিল, প্রস্তুতিহীন পুলিশ তাহাকে বাহিনীর দলীয় আনুগত্যের সাক্ষ্যপ্রমাণে পরিণত করিল।

নবান্নের সর্বোচ্চ স্তরের অনুমোদন ভিন্ন পুলিশ এতখানি বাড়াবাড়ি করিতে পারে, বিশ্বাস করা কঠিন। অনুমান করা চলে, শত প্ররোচনাতেও হিংসাত্মক হওয়া চলিবে না, এমন কোনও নির্দেশ ছিল না। কিন্তু, তাহার পরও প্রশ্ন থাকিয়া যায়, পুলিশের নিজস্ব বিবেচনার কী হইল? এই প্রশ্নের উত্তরটিও রাজনীতিতেই খুঁজিতে হইবে। পুলিশ শাসকদলের প্রতি অনুগত থাকিবে, যাহারা শাসকের বিরোধী, তাহারা পুলিশেরও শত্রু— এমন একটি সংস্কৃতি পশ্চিমবঙ্গে অনপনেয় হইয়াছে। ফলে, বিরোধী মিছিলে ঝাঁপাইয়া পড়িবার সময় পুলিশের স্বাভাবিক বোধগুলিও কাজ করে নাই বলিয়াই অনুমান। অবশ্য, মানসিক ও প্রক্রিয়াগত ভাবে নিজেদের প্রস্তুত করিবার সময় পুলিশের কোথায়? তাহাদের ফুটবল খেলিতে হয়, রক্তদান শিবিরের আয়োজন করিতে হয়। যাঁহার নির্দেশে, এই দায়টিও অতএব তাঁহার উপরই বর্তায়।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন