সম্পাদকীয় ১

তৃতীয় সূত্র

একটি নির্বাচনে বিজয়ী এবং প্রধান বিরোধী, উভয় দলেরই ভোটের অনুপাত আগের তুলনায় বাড়িয়াছে, এমন ঘটনা রোজ ঘটে না। কাঁথি বিধানসভা কেন্দ্রে গত বছরের নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস প্রায় ৫৪ শতাংশ ভোট পায়, এ বার উপনির্বাচনে তাহার অর্জন প্রায় ৫৬ শতাংশ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০
Share:

একটি নির্বাচনে বিজয়ী এবং প্রধান বিরোধী, উভয় দলেরই ভোটের অনুপাত আগের তুলনায় বাড়িয়াছে, এমন ঘটনা রোজ ঘটে না। কাঁথি বিধানসভা কেন্দ্রে গত বছরের নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস প্রায় ৫৪ শতাংশ ভোট পায়, এ বার উপনির্বাচনে তাহার অর্জন প্রায় ৫৬ শতাংশ। অন্য দিকে, ভারতীয় জনতা পার্টির প্রাপ্ত ভোট ৯ শতাংশ হইতে বাড়িয়া পৌঁছাইয়াছে ৩১ শতাংশে। এই বিরল অঙ্কে নিহিত আছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির একটি গূঢ় সত্য। এক কথায় তাহাকে বলা চলে: মেরুকরণ। মেরুকরণের নানা চরিত্র থাকিতে পারে, নানা কার্যকারণসূত্র, নানা চালিকা শক্তি। পশ্চিমবঙ্গে সেগুলি কী ও কেমন, তাহা পরের কথা। কিন্তু কারণ যাহাই হউক, ভোটের ফল যে দুইটি মেরুতে ভাগ হইয়া গিয়াছে, তাহা অনস্বীকার্য। সিপিআই (১০ শতাংশ) এবং কংগ্রেস (১) মাঠের বাহিরে নিক্ষিপ্ত।

Advertisement

একটি বিধানসভার উপনির্বাচন হইতে রাজ্য রাজনীতির সামগ্রিক গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে কোনও নিশ্চিত সিদ্ধান্ত করিলে তাহা হইবে বাতুলতা। কিন্তু সিদ্ধান্ত না হউক, অনুমান অর্থহীন নহে। দেশ জুড়িয়া নরেন্দ্র মোদীর দলটির যে উত্থান এখন সুস্পষ্ট, পশ্চিমবঙ্গেও তাহার প্রভাব আছে। অতীতেও এমন প্রভাব দেখা গিয়াছে, ২০১৪ স্মরণীয়। কিন্তু এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির দ্রুত অগ্রগতির পিছনে বাড়তি কিছু কারণ যুক্ত হইয়াছে। এক, বিরোধী রাজনীতিতে খেলোয়াড়ের ঘোর অনটন। কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘকাল হীনবল, তাহার উপর এই দলের লাগাতার সর্বভারতীয় ক্ষয় চলিতেছে। অন্য দিকে সিপিআইএম তথা বামফ্রন্টের সংগঠন ও বোধবুদ্ধি পরস্পর পাল্লা দিয়া বিলীয়মান, দলের দুর্বার অধোগতি তাহারই অনিবার্য পরিণাম। এই দুই দলই মানুষ আস্থা হারাইয়াছে। হারাইবারই কথা— নিজের উপর কোনও বিশ্বাস নাই যাহার, তাহাকে কে বিশ্বাস করিবে? প্রকৃতি বা রাজনীতি, কেহই শূন্যস্থান সহ্য করে না। ফাঁকা মাঠে উঠিয়া আসিয়াছে মোদী-ধন্য বিজেপি। এক বছরে কাঁথিতে তাহার ভোটের হার ৯ শতাংশ হইতে সাড়ে তিনগুণ হইয়াছে, ইহা সেই অগ্রগতির পরিণাম ও প্রতীক। সাধারণ ভাবেই রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে এই দলের প্রভাব বাড়িবার নানা সংকেত মিলিতেছে। দেওয়ালের লিখন পড়িবার জন্য অক্ষরজ্ঞানই যথেষ্ট।

রাজ্যের শাসক দলের কাজকর্মও এই প্রেক্ষিতে একটি বড় ভূমিকা লইয়াছে। প্রথমত, পুরসভা, জেলা পরিষদ, স্কুলের পরিচালন কমিটি ইত্যাদি সর্বস্তরে কেবল আমরাই রাজত্ব করিব— বামফ্রন্টের এই প্রাচীন মানসিকতা আত্মসাৎ করিয়া তৃণমূল কংগ্রেস তাহা আরও নগ্ন ভাবে প্রয়োগ করিয়াছে, বিরোধীদের উপর হিংস্র ভাবে চড়াও হইবার প্রেরণা এবং প্ররোচনা অর্জন করিয়া দলের স্থানীয় বাহিনী অতিসক্রিয় হইয়া উঠিয়াছে। বহু ক্ষেত্রে মানুষ শাসকের পীড়ন হইতে বাঁচিবার পথ খুঁজিতেছে ‘শক্তিশালী’ বিজেপির ছত্রছায়ায়, কারণ বাঁচাইবার শক্তি ও সাহস আর কাহারও নাই। ইহার পাশাপাশি কাজ করিতেছে শাসক দলের কিছু কিছু প্রত্যক্ষ পক্ষপাত, ইমাম ভাতা যাহার একটি দৃষ্টান্ত মাত্র। ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সংখ্যালঘু-তোষণের মধ্যবর্তী ধূসর এলাকাটিতে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকদের অবিবেচক পদচারণা যদি অনেক নাগরিককে বিজেপির দিকে ঠেলিয়া দিয়া, বিস্ময়ের কিছু নাই। আবার, এক দিকে বিজেপির এই উত্থানের প্রতিক্রিয়ায় এবং অন্য দিকে বাম-কংগ্রেসের বিশ্বাসযোগ্যতার সম্পূর্ণ ক্ষয়ের তাড়নায় ভোটদাতাদের একাংশ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুকূলে তরী ভাসাইবেন, তাহাও রাজনীতির নিয়মেই পড়ে। কাঁথির উপকূলে যদি এই প্রক্রিয়া কাজ করিয়া থাকে, বৃহত্তর পশ্চিমবঙ্গেও তাহা করিবে না, এমন কথা হলফ করিয়া বলা কঠিন।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement