প্রতিবাদ? রোহিত ভেমুলাকে নিয়ে সভায় বক্তা অরবিন্দ কেজরীবালের বিরুদ্ধে। ছবি: পিটিআই
আমরা হায়দরাবাদের পাশে আছি
হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে আপ্পা রাও পোডাইল-এর প্রত্যাবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী হিসেবে আমরা উদ্বিগ্ন। এই উস্কানিমূলক আচরণের সূত্র ধরে ক্যাম্পাসে যে পুলিশি তাণ্ডব চলল, আমরা তার কঠোর নিন্দা করছি। সেই ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধ করে দেওয়া অনৈতিক ও অগ্রহণযোগ্য।
হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিক দলিত ছাত্র আত্মহত্যা করেছেন। গত ১৭ জানুয়ারি দলিত গবেষক রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যার ঘটনাটি থেকে দেশ জুড়ে ব্যাপক ছাত্র-বিক্ষোভ আরম্ভ হয়। রোহিতের আত্মহত্যার সময় আপ্পা রাও পোডাইল-ই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন, এবং তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি রোহিত ও অন্য কয়েক জন ছাত্রকে সাসপেন্ড করার ক্ষেত্রে অবিবেচনার পরিচয় দিয়েছিলেন এবং তারই ফলে শেষ অবধি রোহিত আত্মঘাতী হন। দু’মাস ছুটিতে থাকার পর ২২ মার্চ উপাচার্যের দফতরে তাঁর প্রত্যাবর্তন, অতএব, গ্রহণযোগ্য নয়। বিশেষত, তাঁর বিরুদ্ধে তফশিলি জাতি ও জনজাতিভুক্তদের বিরুদ্ধে নৃশংসতা প্রতিরোধ আইনের ধারায় জামিন-অযোগ্য অভিযোগ রয়েছে। রোহিতের আত্মহত্যার দায় কার, সে বিষয়ে তদন্তেরও এখনও নিষ্পত্তি হয়নি।
যে দিন সকালে রাও বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরলেন, সে দিন অভূতপূর্ব হিংস্রতার সাক্ষী থাকল হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হল, ছাত্ররা উপাচার্যের বাড়িতে পাথর ছুড়েছে, ভাঙচুর করেছে। কিন্তু, পুলিশ কী মারাত্মক ভাবে ছাত্রদের ওপর লাঠি চালিয়েছে, তারও ভিডিয়ো ফুটেজ গণপরিসরেই রয়েছে। অভিযোগ, কিছু পুলিশকর্মী নাকি ছাত্রীদের ধর্ষণেরও হুমকি দেন। পুলিশি লাঠি থেকে বাদ যাননি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও।
এই ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়। ক্যাম্পাসে কোথাও কোনও খাবার নেই, ১৪টি মেস-ই বন্ধ। জল নেই, কিছু কিছু জায়গায় বিদ্যুৎ নেই, ইন্টারনেট সংযোগ নেই। স্টুডেন্ট অ্যাকাউন্টের সঙ্গে যুক্ত এটিএম কার্ডও ব্লক করে দেওয়া হয়েছে, যাতে ছাত্ররা অতি প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোও কিনতে না পারেন। কিছু ছাত্র সকলের জন্য রান্নার চেষ্টা করায় পুলিশ তাঁদের বেধড়ক পেটায়। ‘পাবলিক প্লেস’-এ রান্না করার অপরাধে! দেশের অন্যতম বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষ এক অঘোষিত জরুরি অবস্থা জারি করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী হিসেবে আমরা এই ঘটনাক্রমের দিকে বৃহত্তর জনসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। জানাতে চাই, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হওয়ার ‘শাস্তি’ হিসেবে কী অত্যাচার সহ্য করতে হচ্ছে তাঁদের। আমরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকদের পাশে আছি। আমরা জেএনইউ, পুণের এফটিআইআই, আইআইটি মাদ্রাজ, এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র ও শিক্ষকদের পাশে আছি, যাঁরা ভারতীয় সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত স্বাধীনতা অর্জনের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
প্রবাল দাশগুপ্ত, কেশব কুমার, রাকেশ মেহর, অপর্ণা নন্দকুমার,কে ভি নাগেশ বাবু, মহসিন খান।
আমি যা বলেছি ও বলিনি
কলকাতার কড়চা বিভাগে (২১-৩) আমাকে নিয়ে যে ছোট প্রতিবেদনটি বেরিয়েছে, তাতে আমার বক্তব্যের উপস্থাপনায় কিছু ভুল বোঝাবুঝির ক্ষেত্র তৈির হয়ে গিয়েছে। তাই আমার বক্তব্য সংক্ষেপে পরিষ্কার করতে এই চিঠি। প্রথমত, কানহাইয়াদের এখন নিছক গবেষণায় মন দেয়া উচিত, এ কথা কখনওই আমার বক্তব্য ছিল না। যাঁরা কানহাইয়া, তাঁদের শুধু গবেষণায় মন দেওয়ার উপায় সরকার, মিডিয়া, কেউই রাখেনি। অন্যত্র, আরও পাঁচ জনের সঙ্গে, আমি এর প্রকাশ্যে নিন্দা করে কানহাইয়া ও তাঁদের অধ্যাপকদের সমর্থনে বিবৃতিও দিয়েছি।
আমার বক্তব্য ছিল, এমনিতেই আমাদের দেশে ‘দেখিয়া শুনিয়া খেপিয়া’ যাওয়ার মতো অনেক দৈনন্দিন সমস্যা আছে। ছাত্রদের পক্ষে সে সব নিয়ে ক্ষুব্ধ হওয়া খুব স্বাভাবিক। তার ওপর যদি প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, কর্মচারী সংগঠন, ছাত্র সংগঠন, ছাত্র আন্দোলন ইত্যাদি সমস্ত কিছুর ওপরেই তাঁদের অধিকার কায়েম করতে চান, সেখানে ছাত্ররা দলীয় রাজনীতি এড়াবে কী ভাবে? আর এ অবস্থায় তো পড়াশুনোর ব্যবস্থা খানিকটা বিঘ্নিত হতে বাধ্য।
আমার দ্বিতীয় একটি বক্তব্য, যা প্রতিবেদনটির স্বল্প পরিসরে যথাযথ প্রকাশিত হয়নি, তা এই: আমি মানবিক বিদ্যার ছাত্র। এই সকল বিদ্যাচর্চায় বিশ্বের মানে শ্রেষ্ঠ হতে গেলে আধুনিক ও পুরনো অনেক ভাষা শিক্ষা করতে হয়। ইউরোপীয় ইতিহাস কি সাহিত্য গবেষক আট-ন’টি ভাষা মোটামুটি ভাল জানেন, এরকম দৃষ্টান্ত বিরল নয়। পশ্চিমে দেখেছি ভাষা-শিক্ষা ছাত্র-জীবনের অনেক গোড়াতেই শুরু হয়। আমাদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে তা হয় না। ফলে আমাদের ট্রেনিং-এ অনেক সময়েই একটা খামতি থেকে যায়। সেই খামতি মেটানোর অবকাশ পরবর্তী জীবনের ব্যস্ততায় পাওয়া শক্ত। তখন আমাদের মতো মানুষের অনেক অন্য উপায়ের উদ্ভাবনা করতে হয়, সেটাকেই বলেছি ‘বুদ্ধি দিয়ে মেক-আপ করা’। এটা আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থার খামতি, কোনও ব্যক্তি-মানুষের ব্যর্থতা নয়। প্রতিবেদনটিতে আমার বন্ধু গৌতম ভদ্র ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নাম করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, তাঁদের গবেষণা ও পাণ্ডিত্যের প্রতি আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। যে খামতির কথা আমি বলেছি তা সার্বিক ভাবেই প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার, ব্যক্তি-মানুষের নয়।
দীপেশ চক্রবর্তী। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়